Skip to main content

ক্ষমাকারী ও সদাচরণকারী জান্নাতের প্রত্যাশা করতে পারে

 জুমা আলোচনা

গাছিয়া দৌলতপুর উত্তরপাড়া জামে মসজিদ

তারিখ : ০৯.১২.২০২২

বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম

এই মসজিদে প্রথম জুমা আদায়ের সুযোগ হলো। আলহামদু লিল্লাহ। 

গ্রামের অধিকাংশ মসজিদে মুসল্লিরা অনেক বিলম্বে আসেন। অথচ জুমার দিন আমাদের ইদের দিন। সপ্তাহের শ্রেষ্ঠতম দিন। গোসল করে উত্তম পোশাকে সজ্জিত হয়ে আজানের পরপরই আমাদের আল্লাহর ঘরে উপস্থিত হওয়া উচিত। আজানের পরে জুমার নামাজ ও খুতবা শ্রবণ ছাড়া শুধু ব্যবসা-বাণিজ্য নয়, কোনো কাজই জায়েজ নয়। মসজিদে আগমনের ভিত্তিতে সওয়াব লেখা হয়। পর্যায়ক্রমে আগমনের ফলে উট, গরু, ছাগল কুরবানির সওয়াব মুসল্লিদের আমলনামায় লেখা হয়। খতিব মহোদয় যখনই মিম্বরে আরোহন করেন তখনই ফেরেশতারা সওয়াব লেখা বন্ধ করে খুতবা শোনা শুরু করেন। তাই সাড়ে বারোটার সময় আজান হওয়ার সাথে সাথে আপনারা মসজিদে চলে আসবেন। ঢাকায় অনেক মসজিদ রয়েছে যেখানে সাড়ে বারোটার পূর্বেই মসজিদ পূর্ণ হয়ে যায়। এই মসজিদে ১.০০ থেকে ১.২০ মিনিট আলোচনা, এরপর খুতবা এবং নামাজ। মাঝে সুন্নত নামাজের জন্য আলাদা কোনো সময় দেয়া হয় না। জুমার দিনে আপনাদের কাজই হবে খুতবা শ্রবণ ও নামাজ আদায়। প্রয়োজনীয় সুন্নত আদায় শেষে সর্বদা প্রথম কাতারে বসার চেষ্টা করবেন। খতিব মহোদয়ের আলোচনার সময় উপস্থিত হলে বারান্দায় দু'রাত নামাজ দ্রুত পড়ে মসজিদে বসে পড়বেন। প্রথম কাতারে বসা প্রসঙ্গে রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, প্রথম কাতারে দাঁড়ানোয় কতো সওয়াব তা যদি মুসল্লিরা বুঝতো তাহলে লটারি করা লাগতো।

আমি আপনাদের সম্মুখে সহজে জান্নাতে যাওয়ার উপায় বলবো কি? সমস্বরে বলেন, হ্যাঁ। জান্নাতে যাওয়ার সহজ উপায় হলো আল্লাহর বান্দাদের ক্ষমা করা, তাদের সাথে সদাচরণ করা এবং হিংসা-বিদ্বেষ থেকে মুক্ত থাকা। রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, জমিনে যারা আছে তাদের সাথে সদাচরণ করো তাহলে আসমানে যিনি আছেন তিনি (মহান আল্লাহ) তোমাদের সাথে সদাচরণ করবেন। ছোট-বড়ো, ধনি-গরিব সবার সাথে উত্তম আচরণ করতে হবে। সদাচরণের সবচেয়ে বড়ো হকদার হলেন আপন পিতা-মাতা। সুরা বনি ইসরাইলে আল্লাহপাক বলেছেন, পিতা-মাতা উভয়ই বা কোনো একজন যদি বার্ধক্যে উপনীত হন তাহলে উহ্ শব্দ পর্যন্ত উচ্চারণ করো না। সবসময় নম্র আচরণ করিও। রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, বৃদ্ধ মা-বাবার প্রতি প্রসন্নচিত্তে তাকালে কবুল হজের সমান সওয়াব পাওয়া যাবে। একদিন মিম্বরে আরোহনের সময় রসুলুল্লাহ সা. আমিন, আমিন, আমিন বলেন। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞাসা করেন, ইয়া রসুলুল্লাহ সা.! আপনি আমিন, আমিন, আমিন বলছেন কেন? জবাবে বলেন, এইমাত্র জিবরাইল আ. আমাকে বলে গেলেন, যে ব্যক্তি বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে পেল অথচ তাদের খেদমত করে জান্নাত লাভ করতে পারলো না সে যেন ধ্বংস হয়, আমি বললাম- আমিন (দীর্ঘ হাদিসের অংশ)। যাদের বাবা-মা বেঁচে আছেন, তারা বড়ো ভাগ্যবান। আর যাদের বাবা- মা মারা গেছেন তারাও বাবা-মার খেদমত করতে পারেন। যে কোনো ভালো কাজ করে আল্লাহকে বলুন, হে আল্লাহ! তুমি এর সওয়াব আমার পিতামাতার আমলনামায় দান করো। ফলে এর সওয়াব পিতা- মাতার সাথে সাথে আপনিও পাবেন। আল্লাহপাকের শেখানো দোয়া তো রয়েছেই ‘রব্বির হামহুমা কামা রব্বা ইয়ানি ছগিরা’- এই দোয়া ব্যর্থ হবার নয়। কবুল হবেই- যিনি শেখাচ্ছেন তাঁরই কাছে করা দোয়া। বেশি বেশি করে দোয়া করবেন। 

মানুষকে ক্ষমা করুন বিনিময়ে আপনিও আল্লাহর ক্ষমা পাবেন। রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, যে তার ভাইয়ের অপরাধ ক্ষমা করবে আল্লাহপাক কেয়ামতের দিন তার অপরাধ ক্ষমা করবেন। আমাদের সমাজে ক্ষমা করাকে দুর্বলতা ভাবা হয়। অথচ আল্লাহপাক ক্ষমা করাকে সাহসী কাজ বলে আখ্যায়িত করেছেন। জান্নাতে যাওয়ার এটি সহজতম উপায়। প্রতিশোধ গ্রহণ নয় ক্ষমা করুন বিনিময়ে জান্নাত পাবেন। গিবত যে গুনাহের কাজ তা আপনারা ভুলে গেছেন। তাই একত্র হলেই একে অপরের নিন্দা করেন। গিবত হলো অসাক্ষাতে কারো নিন্দা করা। গিবত জেনা অপেক্ষাও জঘন্য। আমরা জেনাকে ঘৃণা করি কিন্তু গিবতকে সেভাবে মনে করি না। আল্লাহপাক সুরা হুমাজায় কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন, নিশ্চিত ধ্বংস তাদের জন্য যারা মানুষকে সামনা-সামনি গালাগাল করে ও পেছনে দোষ প্রচার করে। মানুষকে যারা হেয় করে, চড়-থাপ্পড় মারে, গালাগাল করে, অপমান করে এবং অসাক্ষাতে নিন্দা করে- এরা কেউ আল্লাহর বান্দা হতে পারে না। এদের পরিণতি হুতামা, আল্লাহর আগুন প্রচণ্ডভাবে উত্তপ্ত- উৎক্ষিপ্ত। মনে রাখবেন, জালেমের জন্য জান্নাতে এক ইঞ্চি পরিমাণ জমিও বরাদ্দ নেই যদি তওবা না করে (আল্লাহ ও তাঁর রসুল সা. থেকে এমনটিই জানা যায়)। গিবত হলো মানুষের মধ্যে দোষ রয়েছে সেটি অপরের কাছে প্রকাশ করে তাকে হেয় করা, অপমান করা। অথচ রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, যে তার ভাইয়ের দোষ গোপন রাখবে আল্লাহ কেয়ামতের দিন তার দোষ গোপন রাখবেন। দোষ গোপনকারীর জন্য কত বড়ো সুসংবাদ।

আমাদের দেশে হিংসার চাষ হয়। হিংসা আছে আপন পরিবারে, আত্মীয়-স্বজনের মাঝে, সমাজে, রাজনীতির অঙ্গনে, এমনকি আলেম সমাজের মাঝেও। আপনারা যদি জান্নাতের প্রত্যাশী হন তাহলে অবশ্যই হিংসামুক্ত হয়ে জীবন যাপন করতে হবে। হিংসা শুধু কবিরা গুনাহ নয়, হিংসা মানুষের নেক আমল ধ্বংসকারী কঠিন অপরাধ। রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, আগুন যেমন শুকনা কাঠকে জ্বালিয়ে ভস্ম করে দেয় তেমনি হিংসা মানুষের সকল নেক আমল ধ্বংস করে দেয়। সমাজে মারামারি, গুম-খুন ও গিবতের মূল কারণ হিংসা। শবে কদরসহ বিশেষ বিশেষ রাতে আল্লাহপাক তাঁর অগণিত বান্দাকে ক্ষমা করেন এবং এই সাধারণ ক্ষমা থেকে বাদ পড়ে সেই হতভাগা যে শিরক করে ও হিংসা করে। হিংসুক আল্লাহর কাছে খুবই ঘৃণিত এবং সুরা ফালাকে আল্লাহ হিংসুকের অনিষ্ট থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য তাঁর কাছে সাহায্য চাইতে বলেছেন। যার অন্তরে হিংসা আছে সে বড়ো সংকীর্ণমনা, সে মানুষকে ক্ষমা করতে জানে না। 

আপনাদের সম্মুখে একটি ঘটনা বলতে চাই যা সহজে আপনাদেরকে জান্নাতে পৌঁছে দেয়ার জন্য প্রেরণা হতে পারে। মদিনার মসজিদে রসুলুল্লাহ সা. সাহাবিদের সাথে করে বসে আছেন, এমন সময় এক ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করলে তিনি তার প্রতি দৃষ্টি দিয়ে সাহাবায়ে কেরামদের রা. বলেন, এই মুহূর্তে যে প্রবেশ করছে সে জান্নাতি। এভাবে পরপর তিনদিন তিনি একই ব্যক্তি সম্পর্কে বলেন যে, সে জান্নাতি। রসুলুল্লাহ সা. কর্তৃক সুসংবাদপ্রাপ্ত ব্যক্তি সম্পর্কে একজন সাহাবির জানার আগ্রহ সৃষ্টি হয়। তিনি তার ঘরে তিনদিনের জন্য মেহমান হন। এই তিনদিন তিনি তাঁর মাঝে বাড়তি কিছুই লক্ষ করেন না, একেবারে স্বাভাবিক জীবন। শেষে তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, রসুলুল্লাহ সা. পরপর তিনদিন আপনাকে জান্নাতি বলে ঘোষণা দিলেন অথচ আপনার মাঝে বাড়তি কোনো আমলই লক্ষ করলাম না। জবাবে সেই সাহাবি বললেন, ভাই- আমি তো এমন কোনো আমল করি না যা দ্বারা এভাবে সম্মানিত হবো। তবে প্রতিদিন ঘুমানোর পূর্বে দোয়া-দরুদ পড়ার পর সবাইকে ক্ষমা করে দেই, কারো প্রতি কোনো হিংসা- বিদ্বেষ রাখি না। তখন সেই সাহাবি বললেন, আপনার এই হিংসামুক্ত জীবন ও ক্ষমাশীলতাই আপনাকে এতো মর্যাদাবান করেছে। 

আমি এই গ্রামেরই সন্তান। আপনাদের মধ্যে যারা বয়স্ক, সবার সাথে আমার জানাশোনা রয়েছে। আমি মরহুম মো. লুৎফর মৌলভীর বড়ো সন্তান। গ্রামের মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আপনারা এতো সুন্দর মসজিদ গড়ে তুলেছেন বিশেষ করে এই গ্রামেরই কৃতী সন্তান মরহুম ডা. বাবুলের বড়ো সহযোগিতা ছিল মসজিদ নির্মাণ ও পরিচালনায় এবং তাঁর লন্ডনপ্রবাসী ছেলে সহযোগিতা এখনো অব্যাহত রেখেছেন (ইমাম সাহেবের মাসিক সম্মানী নিয়মিত প্রদান করেন)। দোয়া করি, এই মসজিদের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের খেদমত আল্লাহপাক কবুল করুন, যারা ইন্তেকাল করেছেন তাদেরকে ক্ষমা করে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন এবং জীবিতদের সুস্থতা, দীর্ঘায়ু ও আমৃত্যু ইসলামের ওপর চলার তৌফিক দান করুন।

এটা নিশ্চিত যে আর কোনো নবি-রসুল আসবেন না। মুহাম্মদ সা. শেষ নবি ও শ্রেষ্ঠতম নবি। কিন্তু নবি সা. -এর উত্তরাধিকার (ওয়ারিস) রয়েছেন এবং সেই উত্তরাধিকার হলেন আলেম সমাজ। আলেমদের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা পোষণ করবেন। তাদেরকে অসম্মান বা কষ্ট দেয়া মূলত আল্লাহ ও তাঁর রসুলকে কষ্ট দেয়ার শামিল। কোনো মানুষকে অহেতুক কষ্ট দেয়া মূলত আল্লাহকেই কষ্ট দেয়া। মানুষকে কষ্টদানকারী জালেমকে আল্লাহ তায়ালা বড়ো শক্তভাবেই ধরবেন। তার রেহাই নেই। আর মানুষের সাথে ভালো ব্যবহার আল্লাহরই সাথে ভালো ব্যবহার। মসজিদের খেদমতে নিয়োজিত ইমাম- মুয়াজ্জিন ও অন্যান্যরা খুব কষ্টেই জীবন যাপন করেন। আপনার গাছের প্রথম লাউটা ইমাম সাহেবকে দিন, গরুর দুধ একদিন ইমাম সাহেব ও মুয়াজ্জিন সাহেবকে দিন, আম-কাঁঠালের সময় তাঁদের বাড়িতে কিছু পৌঁছে দিন। উপঢৌকন আদান-প্রদান ভালোবাসার নিদর্শন। তাঁদের প্রতি ভালোবাসা আল্লাহরই জন্য। রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহরই জন্য কাউকে কিছু দান করলো, আল্লাহরই জন্য কাউকে দেয়া থেকে বিরত থাকলো, আল্লাহরই জন্য কাউকে ভালোবাসলো এবং আল্লাহরই জন্য কারো সাথে শত্রুতা করলো সে তার ইমান পূর্ণ করলো। আল্লাহপাক আমাদেরকে তাঁর পথে চলাটা সহজ করে দিন। আমিন। আংশিক পরিমার্জিত।

Comments