Skip to main content

আখেরাতের প্রস্তুতির মাঝেই রয়েছে সাফল্য

 জুমা বক্তৃতা

০৪.০৩.২০২২


বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম

আজ জুমায় মসজিদ উত তাকওয়া, ধানমন্ডির সম্মানিত খতিব আলহাজ মুফতি সাইফুল ইসলাম আল্লাহর হামদ ও রসুলল্লাহ সা.-এর ওপর দরুদ ও সালাম পেশের পর কুরআনের আয়াত উদ্ধৃত করেন, ‘হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে ভয় করো। আর প্রত্যেকেই যেন লক্ষ রাখে, সে আগামীকালের জন্য কী প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। আল্লাহকে ভয় করতে থাক। আল্লাহ নিশ্চিতভাবেই তোমাদের সেই সব কাজ সম্পর্কে অবহিত যা তোমরা করে থাক’- সুরা হাশর ১৮।

খতিব মহোদয় বলেন, আখেরাতের প্রস্তুতির জন্য মাহে রমজান আল্লাহ তায়ালার বড় নেয়ামত। রমজানের আগমন উপলক্ষ্যে রসুলুল্লাহ সা. ও সাহাবায়ে কেরাম অনেক পূর্ব থেকে ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন। আমাদের মাঝে কোনো বিশিষ্ট মেহমানের আগমনের কথা থাকলে পরিবারে তাঁকে নিয়ে যেমন আলোচনা ও প্রস্তুতি চলতে থাকে তেমনি রমজানকে নিয়ে সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে আলোচনা চলতে থাকতো।

মাহে রমজান বড় বরকতের মাস, গুনাহ মাফের মাস, নেকি কুড়াবার মাস, আগামীকাল শুরু হচ্ছে শাবান। মা আয়িশা রা. বলেন, শাবান মাসে রসুলুল্লাহ সা. এতো অধিক পরিমাণে রোজা রাখতেন ও ইবাদত-বন্দেগিতে নিজেকে নিয়োজিত রাখতেন যা অন্য কোনো মাসে করতেন না। শেষে ২/১ দিন বাদে বলা যায় সারা মাসেই রোজা রাখতেন। হঠাৎ করে রমজানের পুরো মাস রোজা রাখা অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে। তাই অভ্যস্ত হওয়া ও প্রস্তুতি হিসেবে আমাদের উচিত শাবান মাসে বেশি বেশি রোজা রাখা। বিশেষ করে সোম ও বৃহস্পতিবার এবং শাবান মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ (আইয়ামে বিজ) রোজা পালন করতে পারি। সাথে সাথে রোজা রাখার দিন সেহরি খাওয়ার পূর্ব দিয়ে আমরা তাহাজ্জুদ পড়তে পারি। আমাদের দুর্ভাগ্য, সাহাবায়ে কেরাম প্রস্তুতি নিতেন বেশি বেশি রোজা রাখা, নফল নামাজ ও দান-সদাকার মধ্য দিয়ে আর আমরা করি বেশি বেশি বাজার করার মাধ্যমে। রমজানকে সামনে নিয়ে ভোক্তা ও ব্যবসায়ী উভয়ই বেশি বেশি মজুদ করে; তার ফলে দ্রব্যমূল্য বাড়ে ও মানুষের কষ্ট হয়।

খতিব মহোদয় গত জুমায় মিরাজুন্নবী সা. সম্পর্কে আলোচনা করেন। মিরাজে আল্লাহপাক তাঁর সৃষ্টির অনেক নিদর্শনাবলী প্রিয়নবি মুহাম্মদ সা.-কে দেখান। বনি ইসরাইলের প্রথম আয়াতেই আল্লাহ তায়ালা তা উল্লেখ করেছেন। মিরাজের রাতে তাঁকে জান্নাত- জাহান্নাম দেখানো হয়। সেখান থেকে ফিরে এসে কোন্ অপরাধে কী শাস্তি তিনি তা বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, জাহান্নামে আমাকে দেখানো হলো- একদল মানুষ তামার আংটার মতো বড় বড় নখ দিয়ে চেহারা খামচায়ে রক্তাক্ত করছে এবং তা বিরতিহীনভাবে করছে। রসুলুল্লাহ সা. জিজ্ঞেস করলে জিবরাইল আ. বলেন, দুনিয়ায় যারা একে অপরের গিবত, পরনিন্দা করতো তার শাস্তি হিসেবে এটি দেয়া হচ্ছে। পবিত্র কুরআনে গিবতকে মরা ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সাথে তুলনা করা হয়েছে। কবর আজাব সম্পর্কে রসুলুল্লাহ সা. বলেন, পেশাব থেকে সতর্ক না হওয়া ও গিবত করার কারণে কবরে শাস্তি দেয়া হয়। গিবত এখন আমাদের বিনোদনের মতো হয়ে পড়েছে। একত্র হলে অপরের গিবতের মধ্য দিয়ে আমরা আনন্দ পেতে চাই। আসুন, আমরা সবধরনের গিবত থেকে নিজেদেরকে দূরে রাখি।

জাহান্নামের শাস্তি প্রসঙ্গে রসুলুল্লাহ সা. বলেন, আমাকে দেখানো হলো, একদল নারী-পুরুষ সম্মুখে তাজা উপাদেয় খাবার রেখে বাসি-পচা ও দুর্গন্ধযুক্ত খাবার ভক্ষণ করছে। আমি জিজ্ঞেস করলে জিবরাইল আ. বলেন, এরা হচ্ছে তারা যারা ঘরে বৈধ স্বামী/স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও পরকীয়ায় লিপ্ত হয়ে যিনা-ব্যাভিচার করতো। বর্তমান সমাজে যিনা-ব্যাভিচার, নগ্নতা-অশ্লীলতা ব্যাপকভাবে প্রসার ঘটেছে। সমাজে অশ্লীলতার প্রসার বালা-মুসিবতের অন্যতম কারণ। বয়স হলে সন্তানদের বিয়ে-সাদীর ব্যবস্থা এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রসার ছাড়া ব্যাভিচার রোধ করা সম্ভব নয়।

জাহান্নামের শাস্তি প্রসঙ্গে রসুলুল্লাহ সা. আরো বলেন, আমাকে দেখানো হলো যে একদল মানুষ রক্তের সাগরে সাঁতরাচ্ছে এবং পাড়ে আসলে বড় বড় পাথর খণ্ড দ্বারা তাদের আঘাত করা হচ্ছে। জিজ্ঞেস করা হলে জিবরাইল আ. বলেন, এরা হচ্ছে তারা যারা দুনিয়ায় সুদের কারবার করতো। সুদ প্রসঙ্গে আল্লাহপাক বলেন, সুদকে হারাম করা হয়েছে। এরপরেও যারা সুদের লেনদেন করবে তারা যেন আল্লাহ ও তাঁর রসুলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলো। এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে সুদের ব্যাপারে আল্লাহর প্রচণ্ড ক্রোধ ও ঘৃণাই প্রকাশ পেয়েছে। আজকে ব্যবসা-বাণিজ্য ও নানাবিধ কেনাকাটায় সুদ জড়িয়ে আছে। আখেরাতে যদি কারো বিশ্বাস থাকে তাহলে দুনিয়ায় সাময়িক কষ্ট হলেও তাদের উচিত সুদ পরিহার করে চলা।

রসুলুল্লাহ সা. বলেন, আমাকে দেখানো হলো, একদল লোকের জিহবা আগুনের কাঁচি দিয়ে কেটে ফেলা হচ্ছে, আবার তা পূর্বের মতো হয়ে যাচ্ছে এবং বিরতিহীনভাবে এমনটি করা হচ্ছে। এভাবে কাদেরকে শাস্তি দেয়া হচ্ছে জানতে চাইলে জিবরাইল আ. বলেন, এরা সেইসব লোক যারা মানুষকে সুন্দর সুন্দর উপদেশ দান করতো অথচ নিজেরা তা পালন করতো না। সুরা সফ ২ ও ৩ নং আয়াতে আল্লাহপাক তাদের সম্পর্কে চরম ক্রোধ প্রকাশ করেছেন। খতিব মহোদয় নিজেকেসহ সকল ওয়ায়িজিনদের পক্ষ থেকে আল্লাহ তায়ালার কাছে পানাহ চান।

মিরাজের রাতে রসুলুল্লাহ সা.-কে বিভিন্ন অপরাধের শাস্তি দেখানো হয়েছে, সেসব অপরাধসমূহ উল্লেখ করে খতিব মহোদয় তাঁর মুসল্লিদেরকে সতর্ক করেন। বান্দা ক্ষমা চাইলে আল্লাহর হক আল্লাহপাক সহজেই ক্ষমা করে দেবেন কিন্তু বান্দার হক নষ্টকারীকে আল্লাহ ক্ষমা করবেন না বরং কিয়ামতের দিন মজলুমকে জালেমের কাছ থেকে আদায় করে দেয়া হবে। মানুষের হক নষ্ট করা সকল অপরাধ কবিরা গুনাহ এবং তা শাস্তিযোগ্য। শুধু তওবা করলেই হবে না সাথে সাথে যার হক নষ্ট করা হয়েছে তার হক ফিরিয়ে দিতে হবে। জান্নাতে প্রবেশের পূর্ব দিয়ে কিছু লোককে আটকে দেয়া হবে। তারা হলো দুনিয়ায় মানুষের হক নষ্টকারী বা জালেম। যাদের হক নষ্ট করা হয়েছে সেদিন তাদের হক পূরণ করা হবে হক নষ্টকারীদের নেক আমল দিয়ে। নেক আমল শেষ হয়ে যাওয়ার পর মজলুমের গুনাহ জালেমের ঘাড়ে চাপানো হবে এবং তাকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। রসুলুল্লাহ সা. মানুষের হক নষ্টকারী ব্যক্তিকে হতদরিদ্র ও নিঃস্ব বলে আখ্যায়িত করেছেন। আমাদের সমাজে জুলুম-নির্যাতন ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। ফলে সমাজে শান্তি- স্বস্তি বিদায় নিয়েছে। মনে রাখতে জালেম কখনই রেহাই পাবে না এবং অনেক সময় দুনিয়াতেও শাস্তি দেয়া হয়।

রসুলুল্লাহ সা. জান্নাতেরও কিছু বর্ণনা দিয়েছেন। মিরাজের রাতে ভ্রমণকালে একপর্যায়ে রসুলুল্লাহ সা. সুন্দর ঘ্রাণ পান। তিনি জিবরাইল আ.-কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ফেরাউনের কন্যার দাসীর চুলের গন্ধ। সেই দাসীর হাত থেকে চিরুনি পড়ে গেলে সে সেটি তোলার সময় বলে উঠে বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার। তাৎক্ষণিক ফেরাউন কন্যা বলে, আমার বাবার চেয়ে বড় কেহই নেই। তোমার কথা প্রত্যাহার না করলে আমি বলে দিব। সেই দাসী কোনো অবস্থাতেই তার ঈমান ত্যাগ করতে রাজি হয়নি। নানা কলাকৌশল প্রয়োগ করে তাকে ঈমান থেকে বিচ্যুত করা সম্ভব না হওয়ায় আগুনের কুণ্ডলি তৈরি করে তার সামনে একে এক তার সন্তানদের নিক্ষেপ করা হয়। শেষে তার কোলে থাকা দুগ্ধপানকারী শিশুকে নিতে চাইলে সে একটু উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে। আল্লাহপাকের ইচ্ছায় শিশুর জবান খুলে যায় এবং মাকে বলে, তুমি বিচলিত হয়ো না। শেষে শিশুসহ তাকে হত্যা করা হয়। ঈমানের প্রশ্নে আপোষহীন সেই মহীয়সী নারীর জন্য আল্লাহপাক জান্নাতে ঘর নির্মাণ করে দিয়েছেন। ঈমান মানুষকে দুনিয়ার সকল সুখ-শান্তি বিসর্জন ও সবধরনের ত্যাগ স্বীকারের জন্য দৃঢ় করে।

রসুলুল্লাহ সা. বলেন, জান্নাতে আমি বিলালের পদধ্বনি শুনতে পাই। বিলাল রা.-কে তিনি জিজ্ঞেস করেন, তোমার এমন কী আমল রয়েছে যার জন্য আল্লাহপাক তোমাকে এতো মর্যাদা দান করেছেন। জবাবে বিলাল রা. বলেন, আমার এমন কোনো আমল নেই তবে আমি সবসময় ওজু অবস্থায় থাকার চেষ্টা করি এবং যখনই ওজু করি তখনই দু’রাকাত নামাজ আদায় করি। রসুলুল্লাহ সা. বলেন, আমাকে ওমরের রা. ঘরও দেখানো হয় তবে আমি সেই ঘরে প্রবেশ করা থেকে নিজেকে বিরত রাখি।

খতিব মহোদয় বলেন, একটি মাস পরেই আমরা মহা সম্মানিত ও বরকতের মাস রমজানকে পাবো। কুরআনের কারণেই রমজানের এতো ফজিলত ও বরকত। তিনি বেশি বেশি করে কুরআন তেলাওয়াতের জন্য বলেন এবং অর্থসহ পড়ার তাগিদ দিয়ে বলেন, তাতে আল্লাহর আদেশ নিষেধ সম্পর্কে অবহিত হয়ে নিজেকে পরিশুদ্ধ করা সম্ভব হবে। রমজান মাসে কিছু কর্মসূচি গ্রহণের জন্য তিনি মসজিদ কমিটিকে অনুরোধ করেন। শিশু-কিশোরদের কুরআন মুখস্থ করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে বলেন, যারা অন্তত আমপারা মুখস্থ করবে তাদেরকে পুরস্কৃত করা হবে ইনশা-আল্লাহ। রমজানের মর্যাদা বজায় রাখা এবং তা থেকে ফায়দা লাভের জন্য তিনি তাঁর মুসল্লিদের প্রতি আহবান জানান।

Comments