সরল অনুবাদ
‘‘যখন আকাশ ফেটে
যাবে, যখন তারকাসমূহ চারদিকে বিক্ষিপ্ত হয়ে যাবে, যখন সমুদ্রসমূহ ফাটিয়ে ফেলা হবে,
এবং যখন কবরগুলো খুলে ফেলা হবে, তখন প্রত্যেক ব্যক্তি তার সামনের ও পেছনের সবকিছু জেনে
যাবে।
হে মানুষ! কোন্
জিনিস তোমাকে তোমার মহান রবের ব্যাপারে ধোঁকায় নিমজ্জিত করেছে, যিনি তোমাকে সৃষ্টি
করেছেন, তোমাকে সুঠাম ও সুসামঞ্জস্য করে গড়েছেন এবং যে আকৃতিতে চেয়েছেন তোমাকে গঠন
করেছেন?
না, কখনো নয়,
বরং (আসল কথা হচ্ছে এই যে) তোমরা শাস্তি ও পুরস্কারকে মিথ্যা মনে করছো। অথচ তোমাদের
ওপর পরিদর্শক নিযুক্ত রয়েছে, এমন সম্মানিত লেখকবৃন্দ, যারা তোমাদের প্রত্যেকটি কাজ
জানে।
নিশ্চয়ই নেক লোকেরা
পরমানন্দে থাকবে আর পাপীরা অবশ্যি জাহান্নামে যাবে। কর্মফলের দিন তারা তার মধ্যে প্রবেশ
করবে এবং সেখান থেকে কোনক্রমেই সরে পড়তে পারবে না।
আর তোমরা কি জানো,
ঐ কর্মফল দিনটি কী? হ্যাঁ, তোমরা কি জানো, ঐ কর্মফল দিনটি কী? এটি সেই দিন যখন কারোর
জন্য কোন কিছু করার সাধ্য কারোর থাকবে না। ফয়সালা সেদিন একমাত্র আল্লাহর ইখতিয়ারে থাকবে।’’ (সূরা আল ইনফিতার
১৯)
নামকরণ : প্রথম
বাক্যের ইনফিতার শব্দটিকে নাম হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে, যার অর্থ ফেটে যাওয়া। সাধারণত
অধিকাংশ সূরার মত এখানে চিহ্নস্বরূপ এই নামকরণ করা হয়েছে।
নাযিলের সময়কাল
: মক্কী সূরা এবং প্রাথমিক অবস্থায় অবতীর্ণ। মক্কাবাসীদেরকে আখিরাত সম্পর্কে সচেতন
করা প্রথম যুগের অবতীর্ণ সূরাসমূহের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
বিষয়বস্তু ও মূল
বক্তব্য : সূরাটির বিষয়বস্তু আখিরাত। হযরত ইবনে উমর (রা) বর্ণিত একটি হাদিস, ‘যে ব্যক্তি কিয়ামতের
দিনটি নিজের চোখে দেখতে চায় সে যেন সূরা তাকভীর, সূরা ইনফিতার ও সূরা ইনশিকাক পড়ে নেয়।’
এই সূরায় প্রথমে
কিয়ামতের বর্ণনা দেয়া হয়েছে এবং সে সময়ে দুনিয়ায় কৃত ভালো ও মন্দ সকল কর্ম প্রত্যেকেই
দেখবে। তারপর মানুষের সৃষ্টি এবং সকল সৃষ্টির মধ্যে অনন্য বৈশিষ্ট্য ও জ্ঞান-যোগ্যতা
দিয়ে শ্রেষ্ঠত্বদানের পরও তার রবকে ভুলে থাকার কারণ যে আখিরাতে অবিশ^াস সেটি ব্যক্ত
করা হয়েছে।
মানুষকে সতর্ক করে বলা হয়েছে যে, সম্মানিত লেখকবৃন্দ তার গতিবিধি, চালচলন
ও কর্মকান্ড সব লিপিবদ্ধ করছেন এবং নেককারদের শুভ পরিণতি ও বদকারদের কঠিন শাস্তির কথা
এই সূরায় বলা হয়েছে। সেদিনে কোন সুপারিশ গ্রহণযোগ্য হবে না।
ব্যাখ্যা : প্রথম
তিনটি আয়াতে কিয়ামত দিনের প্রাথমিক অবস্থার বর্ণনা দেয়া হয়েছে। কুরআন মজিদে বিভিন্ন
জায়গায় কিয়ামতের বর্ণনা রয়েছে। বর্তমানে যে শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতার ভিত্তিতে এ বিশ্বজাহান
পরিচালিত হচ্ছে, আল্লাহপাক নিজেই একদিন তা ভেঙ্গে দেবেন।
হাদিসে সিঙ্গায় তিনটি ফুৎকারের
কথা বলা হয়েছে। প্রথম ফুৎকারে এক প্রলয়ঙ্কারী ভূমিকম্প, তা কোন এক নির্দিষ্ট এলাকায়
নয় সমগ্র বিশ্বব্যাপী সংঘটিত হবে। এখানে বলা হয়েছে যে আকাশ ফেটে যাবে, তারকাসমূহ বিক্ষিপ্ত
হয়ে পড়বে এবং সমুদ্রসমূহ ফেটে যাব্ েকোথাও বলা হয়েছে সমুদ্রসমূহে আগুন জ¦লতে থাকবে।
কোথাও বলা হয়েছে পাহাড়সমূহ ধূলা পশমের মত উড়তে থাকবে। মোট কথা পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা,
খাল-বিল, সাগর-মহাসাগর সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবে এবং এ জমীন এক সমতল ভূমিতে পরিণত হবে।
মনে হবে যেন একটি দস্তরখানা বিছায়ে দেয়া হয়েছে।
পরবর্তী ফুৎকারে সব মানুষ কবর থেকে
উঠে আসবে এবং সে তখন সামনের ও পেছনের ঘটে যাওয়া সকল কৃতকর্ম জানতে পারবে। অর্থাৎ সে তার জীবদ্দশায় ভালো-মন্দ যা করেছে তা
যেমন জানতে পারবে তেমনি মৃত্যুর পরে তার রেখে আসা আমলের দ্বারা অন্যান্যরা প্রভাবিত
হলে তারও ছওয়াব ও গুনাহের সে ভাগীদার হবে।
৬-১২ আয়াতে মানুষের
সুন্দর গঠন, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসমূহের সুসামঞ্জ্যকরণ ও বিভিন্ন আকৃতিতে সৃষ্টির বিষয় উল্লেখ
করে তার মধ্যে সম্বিত ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়েছে। ময়ের গর্ভে পিতার শুক্রকীট নিক্ষেপ
এবং ক্রমবিকাশের মাধ্যমে মানবশিশুর জন্ম আল্লাহর এক বিষ্ময়কর সৃষ্টি। মানবশিশুর বেড়ে
উঠা, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সংযোজন, প্রাণের সঞ্চার আল্লাহর ইচ্ছার ফলেই সম্ভব হয়।
তারপর
মানুষের আকার-আকৃতি, চেহারা, কন্ঠস্বর, এমন কী বৃদ্ধাঙ্গুলির ছাপের ভিন্নতাসহ প্রত্যেককে
একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য দিয়ে সৃষ্টি আল্লাহপাকের অসীম জ্ঞান ও প্রজ্ঞারই পরিচায়ক।
হযরত আদম (আ) থেকে শুরু করে কিয়ামত পর্যন্ত যত মানুষ এ দুনিয়ায় আসবে কারো সাথে কারো
কোন মিল হবে না; সবাই স্বতন্ত্র দৈহিক কাঠামো, রুচি-পছন্দ নিয়ে এ পৃথিবীতে আগমন করবে-এ
সব চিন্তা করলে আল্লাহর প্রতি বিনয়াবনত না হয়ে উপায় থাকে না।
কিন্তু মানুষ উল্টো তাঁর
নাফরমানিতেই লিপ্ত রয়েছে। আল্লাহর ভাষায় এর মূলে কারণ একটিই এবং তা হলো আখিরাতের প্রতি
অবিশ^াস। অথচ মানুষের ভালো-মন্দ সকল কাজই আল্লাহর নিযুক্ত ফেরেশতা কর্তৃক রেকর্ডভুক্ত
হচ্ছে এবং তাঁরা হলেন সম্মানিত, অর্থাৎ তাঁরা এমন নন যে, কোন ধরনের পক্ষপাতিত্ব বা
ঘুষ-দুর্নীতির বিনিময়ে মিথ্যা লেখার মত তাঁরা নন।
তাঁদের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য এই যে,
তাঁরা দুনিয়ার সরকারসমূহের ইন্টেলিজেন্স ডিপার্টমেন্টের মত নন যারা হাজারো চেষ্টা করেও
অনেক সময় প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটনে ব্যর্থ হন। আল্লাহর ফেরেশ্তারা সকল বিষয়ে জ্ঞাত; কোন
কিছুই তাঁদের অগোচরে নয়।
পৃথিবীতে মানুষের
আচার-আচরণ, চাল-চলন ও কর্মকান্ডে যেমন ভিন্নতা রয়েছে, তেমনি আখিরাতে তাদের পরিণতিও
ভিন্ন হবে। এখানে আল্লাহ তায়ালা স্পষ্ট করেছেন যে, বর্তমান দুনিয়ায় যারা নেক কাজ করবে
তারা আখিরাতে পরমানন্দে থাকবে; পক্ষান্তরে পাপীদের জন্য রয়েছে ভয়াবহ আযাব। যারা জাহান্নামে
যাবে কখনই সেখান থেকে তারা সরে পড়তে পারবে না। সেদিনের অবস্থা ব্যাখ্যা করতে যেয়ে আল্লাহপাক
বলেছেন, আখিরাতে কোন সুপারিশ গ্রহণযোগ্য হবে না।
অতীতকালে মানুষের একটি ধারণা ছিল যে,
নবী-রসূল বা আল্লাহর নেক বান্দারা বা তাদের উপাস্য দেবতারা সুপারিশ করে তাদেরকে জাহান্নামের
আগুন থেকে বাঁচিয়ে দিবে। এ ভ্রান্তি বর্তমানেও রয়েছে, যার কারণে মানুষ বিভিন্ন মাজার
ও দরবারে ঘুরাঘুরি করে। এখানে বলা হয়েছে, কারোর জন্য কোন কিছু করার সাধ্য কারোর থাকবে
না। ফয়সালা সেদিন একমাত্র আল্লাহর ইখতিয়ারে থাকবে।
অবশ্য শিরকমিশ্রিত শাফায়াতের পরিবর্তে
ইসলাম আমাদের সম্মুখে তাওহীদভিত্তিক সুপারিশের ধারণা প্রদান করেছে। সুপারিশ প্রসঙ্গে
কুরআন মজিদে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ যাকে অনুমতি দেবেন এবং যার জন্য সুপারিশ পছন্দ করবেন
কেবল তিনিই সুপারিশ করতে পারবেন। আল্লাহর ওপর প্রভাব বিস্তার করে বা সুপারিশের মাধ্যমে
কাউকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করে নেয়ার ক্ষমতা সেদিন কারো থাকবে না।
আল্লাহপাকের ক্ষমা
করার একটি প্রক্রিয়া হিসেবে সেদিন কিছু লোককে তিনি সুপারিশ করার সুযোগ দান করবেন (নবী-রসূল
ও নেক বান্দারা) এবং এর মাধ্যমে তিনি তাঁর নেক বান্দাদের মর্যাদা উচ্চে তুলে ধরবেন
ও কিছু গোনাহগার বান্দাকে শাস্তি থেকে রেহাই দান করবেন।
শিক্ষা : আখিরাতের
প্রতি ঈমান আনায়নই এই সূরার মৌলিক শিক্ষা। সমাজে জুলুম-নির্যাতন ও নানাবিধ পাপাচারের
মূল কারণ আখিরাতে অবিশ্বাস। প্রথমত কিয়ামতের ভয়াবহ অবস্থার বর্ণনা দেয়া হয়েছে; এরপর
মানুষের সৃষ্টি প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেছেন যে, আল্লাহর নাফরমানির পেছনে পরকাল অবিশ্বাস
ছাড়া আর কোন কারণ নেই।
আল্লাহপাক আমাদেরকে
পরকাল বিশ্বাসের মাধ্যমে সকল পাপাচার থেকে মুক্ত থেকে নেক আমল করার তাওফিক দান করুন।
Comments
Post a Comment