Skip to main content

দারসুল কুরআন সূরা মাউন


‘‘তুমি কি তাকে দেখেছ যে কিয়ামতের বদলাকে (পুরস্কার ও শাস্তিকে) মিথ্যা মনে করে? সে তো সেই লোক যে ইয়াতিমকে ধাক্কা দেয় এবং মিসকিনকে খাবার দিতে উৎসাহিত করে না। তারপর সেই সব নামাযীদের জন্য ধ্বংস, যারা নিজেদের নামাযের ব্যাপারে অবহেলা করে, যারা লোক দেখানো কাজ করে এবং নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস অপরকে দেয়া থেকে বিরত থাকে।’’ (সূরা মাউন ১-৭)

ছোট্ট এই সূরাটিতে আখিরাতে অবিশ্বাসের ফলে মানুষের মধ্যে যে সব দোষ-ত্রুটি দেখা যায় তা তুলে ধরা হয়েছে এবং এটি মূলত তৎকালীন সমাজেরই একটি চিত্র। সেই সমাজে ইয়াতিম, মিসকিন ও অসহায়দের প্রতি সমাজের প্রভাবশালী লোকদের আচরণ ছিল বড়ই ঘৃণ্য ও নিন্দনীয় এবং সমাজপতি আবু জেহেলের বিরুদ্ধেও এক ইয়াতিম বালকের সম্পদ আত্মসাতের কথা জানা যায়।

তুমি কি দেখেছ? কথাটি বাহ্যত নবী (সা.)-কে উদ্দেশ্য করে বলা হলেও কুরআন অধ্যয়নকারী সকলের উদ্দেশ্যেই বলা হয়েছে। মানুষের মধ্যে নৈতিক চরিত্রের যে সব খারাপ দিকগুলো এখানে উল্লেখ করা হয়েছে, কারো মধ্যে এ সব ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকার অর্থই হলো সে আখিরাতকে অবিশ্বাস করে। আখিরাতে পুরস্কার ও শাস্তিতে বিশ্বাসী কোন ব্যক্তি কখনই ইয়াতিম-মিসকিন ও অসহায়দের সাথে দুর্ব্যবহার বা তাদের প্রাপ্য আত্মসাৎ করার চিন্তা করতে পারে না।

সকল সৃষ্টির সাথে সদাচরণ করার জোর তাগিদ দেয়া হয়েছে ইসলামে। মানুষ সাধারণত দুর্ব্যবহার করে তার চেয়ে অপেক্ষাকৃত দুর্বলদের সাথে। কেবল পরকালে বিশ্বাস ও জবাবদিহিতাই পারে মানুষকে সদাচারী হতে। কুরআনের উক্তি তোমাদের সম্পদে প্রার্থী ও বঞ্চিতদের হক রয়েছে। মিসকিনকে খাবার খাওয়ানো মূলত তার প্রাপ্যটাই আদায় করা। একটি বিশ্বাসী সমাজে ইয়াতিম-মিসকিন ও সহায়হীনদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসার লোকের অভাব হওয়ার কথা নয়।

ঈমান আনার পর যে কাজটি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ তা হলো নামায আদায়। কোন বেনামাযীর মুসলমান হওয়ার সুযোগ নেই। কুরআনের বক্তব্য-নামায নিঃসন্দেহে কঠিন কাজ, কঠিন নয় তাদের জন্য যারা (পরকালে) আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের ভয় রাখে

আল্লাহ আরো বলেন-জাহান্নামীদের জিজ্ঞাসা করা হবে-কোন জিনিস তোমাদেরকে জাহান্নামে নিয়ে আসলো, তারা বলবে-আমরা নামাযী লোকদের মধ্যে গণ্য ছিলাম না। নামায আদায় না করাটা অবিশ্বাসীদের কাজ। এই সূরায় মুনাফিকদের কথা বলা হয়েছে, যারা নামায আদায়ে আন্তরিক নন, গাফিলতি করে, নামাযে নিয়মিত নন, সময়মত ও জামাতে আদায় করে না।

পরকালে বিশ্বাসের ঘাটতির কারণেই এ সব দুর্বলতা দেখা দেয়। এ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য প্রয়োজন উত্তম পোশাকে সজ্জিত হয়ে নিয়মিত জামাতে নামায আদায় (ভয় বা বিপদের আশংকা না থাকলে)।

হাদিসের ভাষা তাই বলে। হযরত আলী (রা.)-এর উক্তি-মসজিদের প্রতিবেশিদের নামায মসজিদেই আদায় করতে হবে। জিজ্ঞেস করা হলো-মসজিদের প্রতিবেশি কারা? জবাবে বললেন-যারা আযান শুনতে পায়। আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার (আল্লাহ মহান, আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ); হাই আলাচ্ছালাহ-হাই আলাল ফালাহ (নামাযের দিকে এসো-কল্যাণের দিকে এসো); আচ্ছালাতু খাইরুম মিনান নাউম (ঘুম হতে নামায উত্তম)-এ সব বাক্য কানে পৌঁছার পর আর মুমিন স্থির থাকতে পারে না-সে তখন ছুটে চলে তার মহান প্রভূর পানে তাঁরই ঘরে এবং পেশ করে নিজের সকল অক্ষমতা ও চাওয়া-পাওয়া।

নামায আদায় না করা যেমন কুফুরি, তেমনি নামায পড়তে এসে অবহেলা প্রদর্শনও ধ্বংসের কারণ (ওয়াইল এমন একটি দোযখ যেখানে জাহান্নামীদের পুঁজ-রক্ত জমা হয়)। এ কথাও স্মরণযোগ্য যে, নামায আদায় করতে যেয়ে নামাযের মধ্যে ত্রুটি-বিচ্যুতি ঘটে যাওয়ার কথা এখানে বলা হয়নি (বলা হয়েছে যে নামাযের ব্যাপারে অবহেলা করে) এবং এমন ধরনের ত্রুটি-বিচ্যুতি খুবই স্বাভাবিক যা সহু সিজদার মাধ্যমে সমাধান করা হয়।

শুধু নামাযই নয় ইসলাম চায় যে, তার অনুসারীরা সকল কাজে আন্তরিকতা, নিষ্ঠা ও একাগ্রতা প্রদর্শন করবে। লোককে দেখানো উদ্দেশ্যে নয়, আল্লাহর সন্তুষ্টির অর্জনের লক্ষ্যে সকল কাজেই আন্তরিক হবে। চাকুরী, ব্যবসা-বাণিজ্য, খেত-খামার-যে যেখানে যাই করুক না কেন সবই ইবাদত এবং সকল কাজে নিষ্ঠা অবশ্বম্ভাবী।

পরকাল অবিশ্বাসীরা বড়ই অনুদার ও সংকীর্ণমনা হয়ে থাকে। এই সমাজে মানুষ পরস্পরের প্রয়োজনে এগিয়ে আসবে এটাই স্বাভাবিক। সংসারের সকল প্রয়োজনীয় জিনিস সবার ঘরে থাকে না। দা, কুড়াল, খুন্তি, বাড়তি তৈজসপত্র ইত্যাদি জিনিস প্রতিবেশিরা পরস্পরে আদান-প্রদানের মাধ্যমে তাদের প্রয়োজন পূরণ করে থাকেন।

সন্তুষ্টচিত্তে প্রতিবেশি ও আত্মীয়-স্বজনকে দেয়ার মধ্য দিয়ে সম্পর্কের উন্নতির সাথে সাথে প্রভূত সওয়াব লাভ করা যায়। আল্লাহ যেমন উদার ও প্রশস্ততার অধিকারী, তেমনি তিনি চান তাঁর বান্দারাও তাঁর গুণে গুণান্বিত হবে অর্থাৎ উদার ও দরাজদীল হবে। তাঁর বাণী-যে স্বীয় মনের সংকীর্ণতা থেকে নিজেকে রক্ষা করলো সেই প্রকৃত কল্যাণ লাভ করলো

একজন মুসলিম তার ভাই-এর প্রয়োজন পূরণ করে, তার ভাই-এর অপরাধ গোপন ও ক্ষমা করে এবং করে কোন বিনিময় ছাড়াই, কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি ও আখিরাতে উত্তম বিনিময়ের আশায়। ২০/১১/২০১৫

Comments