সূরা হুমাযাহ এর দারস সত্যিই শিহরণ জাগায়। আসুন পর্যায়ক্রমে দারসুল কোরআন সূরা হুমাযা এর ব্যাখ্যা ও শিক্ষা জেনে নিই।
সরল অর্থ
‘নিশ্চিত ধ্বংস তাদের জন্য যারা মানুষকে সামনা-সামনি গালাগাল ও পেছনে দোষ প্রচার করে, ধ্বংস তাদেরও জন্য যারা ধনমাল জমা করে ও গুনে গুনে রাখে। সে তো মনে করে এ ধনমাল তার কাছে চিরকাল থাকবে। কক্ষণই নয়, সে শীঘ্রই চূর্ণ-বিচূর্ণকারী স্থানে নিক্ষিপ্ত হবে। তুমি কি জান সেই চূর্ণ-বিচূর্ণকারী স্থান কী? আল্লাহর আগুন-প্রচন্ডভাবে উত্তপ্ত-উৎক্ষিপ্ত, অন্তর পর্যন্ত স্পর্শ করে। ওপর থেকে ঢাকনা দিয়ে ঢেকে দেয়া হবে, এমতাবস্থায় তা উঁচু উঁচু থামে ঘেরাও হয়ে থাকবে’। ( সূরা হুমাযাহ ১-৯ )
ব্যাখ্যা ও শিক্ষা
মক্কী সূরা এবং প্রাথমিক অবস্থায় অবতীর্ণ। তৎকালীন সমাজের মানুষের বিশেষ করে সম্পদশালী লোকদের নৈতিক ত্রুটি এখানে উল্লেখ করে তাদের ভয়াবহ পরিণতির কথা বলা হয়েছে।
আল্লাহ তায়ালা নবী-রসূল ও কিতাব পাঠিয়েছেন মানব জাতির কল্যাণের জন্য। সেই মানুষকে কষ্ট দেয়া, তাকে হেয় করা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্ল করা, অপমান করা-তা আল্লাহ তায়ালা কখনই মেনে নিতে পারেন না।
কারণ মানুষ তো তাঁর সেরা সৃষ্টি-তাঁরই প্রতিনিধি। তাঁর প্রতিনিধিকে অপমান করা তো তাঁকেই অপমান করা। সাধারণত এমন আচরণ তারাই করে যারা সম্পদশালী ও নানাভাবে ক্ষমতাবান।
এই সমস্ত ক্ষমতাগর্বি লোকেরা কখনো মানুষকে মূল্য দেয় না। তারা ধন-সম্পদের নেশায় মত্ত হয়ে থাকে। আল্লাহ তায়ালার কাছে তাকে একিদন ফিরে যেতে হবে-এমন চেতনা তাদের মধ্যে কাজ করে না।
আবার এমন মানসিকতাসম্পন্ন লোকেরা হয়ে থাকে বড় কৃপণ। সম্পদে তার ও তার পরিবার ছাড়াও যে আল্লাহর হক রয়েছে (অর্থাৎ আল্লাহর অসহায় বান্দাহ ও তাঁর দ্বীনের প্রয়োজনে) তা সে মনে করে না। পরকাল অবিশ্বাসের ফলেই এমনটি হয়ে থাকে।
এর পরিণতি বড় ভয়াবহ। আল্লাহর বান্দাহদের সাথে অসদাচরণকারী লোকদের জন্য রয়েছে হুতামা-যেখানে যা কিছুই ফেলা হবে তা চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেবে। আর আল্লাহর চরম ক্রোধ ও এর ভয়াবহতা বোঝানোর জন্য বলা হয়েছে ‘তা আল্লাহর আগুন’।
কুরআন মজিদে জাহান্নামের আগুনকে এভাবে আল্লাহর আগুন বলা হয়েছে এই একটি মাত্র জায়গায়। মানুষ আল্লাহর বড় আদরের সৃষ্টি, প্রিয় সৃষ্টি-সেই সৃষ্টির সঙ্গে দুর্বব্যবহার-অসদাচরণ, তা হতেই পারে না।
জাহান্নামে কাউকে নিক্ষেপ করলে সেখান থেকে কারো বেরিয়ে আসা অসম্ভব। আগুনে নিক্ষেপ করে ঢাকনা দিয়ে ঢেকে দেয়া এবং তার ওপর উঁচু উঁচু থাম গেড়ে দেয়ার অর্থই হলো শাস্তির তীব্রতা বাড়িয়ে দেয়া।
দাওয়াতের প্রাথমিক পর্যায়ে অবতীর্ণ ছোট ছোট এ সব সূরাগুলো সহজেই মুখস্ত করে রাখার মত এবং ঈমানদাররা সে সময়ে বার বার পড়ে এ সব ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে নিজেদেরকে মুক্ত রাখার প্রয়াস চালিয়েছিলেন। তারা সফলকামও হয়েছিলেন। সর্বক্ষণ অস্ত্রে-শস্ত্রে সজ্জিত মারা-মারি কাটাকাটিতে লিপ্ত মানুষগুলো ঈমান আনার পর কুরআনের বদৌলতে সোনার মানুষে পরিণত হয়ে যান।
দুর্ভাগ্য মুসলমানদের! বিশ্ববাসী আজ মুসলমানকে সন্ত্রাসী ও জঙ্গী হিসেবে জানছে। আসলে ইসলাম ও মুসলমান সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকার কারণেই আজ তারা এভাবে চিহ্নিত করছে। একজন মানুষকে গালি দেয়া ও দুর্ব্যবহার করার পরিণতি যদি হুতামা হয়ে থাকে-তাহলে কাউকে হত্যা করা, কারো অঙ্গহানি ঘটানো কত বড় অপরাধ তাতো কল্পনাও করা সম্ভব নয়।
সন্ত্রাস ও ইসলাম-এ দুই এর অবস্থান সম্পূর্ণ বিপরিত মেরুতে। একজন মুসলমান কখনই সন্ত্রাসী বা জঙ্গি হতে পারে না। রসূল (সা.)-এর বাণী স্মরণযোগ্য-‘ঐ ব্যক্তি মু’মিন নয়, মু’মিন নয়, মু’মিন নয় যার হাত ও মুখের অনিষ্ঠ থেকে অন্যরা নিরাপদ নয়’।
ঈমান ও সন্ত্রাস এক সঙ্গে অবস্থান করতে পারে না। ইসলামের নামে কেউ যদি সন্ত্রাস করে বুঝতে হবে সে শয়তানের শিষ্যত্ব গ্রহণকারী একজন উন্মাদ ও বিভ্রান্ত বা ইসলামের দুশমনদের ভাড়াটে। ইসলাম সদাচরণকে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করেছে। পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, মুসাফির, চাকর-বাকর ও অধীনস্থ, অমুসলিমসহ সকল শ্রেণির মানুষের সাথে উত্তম আচরণের জোর তাগিদ দিয়েছে।
রসূলের (সা.) হাদিস-‘জমিনে যারা আছে তাদের সাথে সদাচরণ কর তাহলে আসমানে যিনি আছেন তিনিও তোমাদের সাথে সদাচরণ করবেন’। তিনি আরো বলেন-‘যারা বড়দের সম্মান ও ছোটদের স্নেহ-আদর করে না তারা আমাদের সমাজভূক্ত নয়’।
এই সমাজে কেউ বড় বা কেউ ছোট-সবার সাথে উত্তম আচরণের তাগিদ রয়েছে এ হাদিসে এবং এটাও ঠিক যে, সদাচরণে কেউ ব্যর্থ হলে সে আর মুসলিম সমাজের অন্তর্ভূক্ত থাকে না।
জিহাদ অত্যন্ত পবিত্র শব্দ-যার অর্থ প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চালনো। আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ অর্থ তাঁর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে তাঁর পথে প্রাণান্ত চেষ্টা করা যা সকল নবী-রসূল ও তাঁদের অনুসারীরা করে গেছেন। কোন নবী-রসূল সন্ত্রাসী বা জঙ্গি ছিলেন না।
আমাদের প্রিয়তম নবী দীর্ঘ তেরটা বছর মক্কার মানুষকে আল্লাহর দিকে ডেকেছেন ও তাদেরকে কুরআনের আলোকে পরিশুদ্ধ করেছেন এবং এ কাজে তিনি সীমাহীন জুলুম-নির্যাতনেরও শিকার হয়েছেন। তারপরও এমন একটি ঘটনা পাওয়া যাবে না যে ইসলামের কোন দুশমনকে গোপনে হত্যা করেছেন বা আহত করেছেন।
যেহেতু মু’মিনরা আল্লাহর সাহায্যকারী হিসেবে তাঁর পক্ষেই কাজ করে থাকেন, তাই প্রতিশোধের চিন্তা কখনই তাদের মাঝে কাজ করে না। বদলা যা নেয়ার তা আল্লাহই নিয়ে থাকেন। অতীতে মু’মিনদেরকে আগুনেভরা গর্তে ছুঁড়ে মারা হয়েছে-তারাও সন্ত্রাসী বা জঙ্গি ছিলেন না।
আল্লাহর ভাষায়-‘তাদের অপরাধ এই যে পরাক্রমশালী আল্লাহর ওপর ঈমান এনেছে’। ফিরাউনের যাদুকররা ঈমান আনলে ফিরাউন তাদের হাত ও পা বিপরিত দিক থেকে কেটে শুলেবিদ্ধ করতে চাইলে সদ্য ঈমান গ্রহণকারী যাদুকরদের বক্তব্য ছিল-‘যা খুশি করো, বড়জোর আমাদের দুনিয়ার জীবনটাকে বরবাদ করতে পারবে’।
সকল ভয়-ভীতি, বিপদ-মুছিবতের মধ্যে ঈমানের ওপর অবিচল থাকার নামই হলো জিহাদ এবং এমতাবস্থায় কেবল ধৈর্যশীলরাই সফলকাম হয়। বিভিন্ন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর যুদ্ধ ঘোষণার কোন সুযোগ ইসলামে নেই। যুদ্ধ ঘোষণার এখতিয়ার রয়েছে রাষ্ট্রশক্তি বা সরকারের যা রসূল (সা.) মদীনায় একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র গঠনের মাধ্যমে করেছিলেন।
সেখানেও মানবতাকে প্রাধান্য দিয়ে যুদ্ধের সাথে সংশ্লিষ্ট নয় এমন নারি-শিশু-বৃদ্ধ ও ফলবান বৃক্ষ, অপরের উপাসনালয় এবং যুদ্ধের প্রয়োজনে পড়ে না এমন বাড়ীঘর ও সম্পদের হানি করা নিষিদ্ধ। যুদ্ধের মাঠে আহত ও পলায়নপর ব্যক্তিবর্গ ও যুদ্ধবন্ধীদের হত্যা করা যাবে না এবং নিহতদের অঙ্গচ্ছেদ বা কোনরূপ অত্যাচার (নর্তন-কুর্দন) করাও যাবে না। যুদ্ধবন্ধীদের সাথে উত্তম আচরণ করতে হবে।
এরই নাম ইসলাম এবং যারা অনুসরণ করে তাদেরই নাম মুসলিম। এত পবিত্র ও শান্তির ধর্ম ইসলামকে কলঙ্কিত করছে ইসলামের নামধারীরাই। ইসলাম এখন এক শ্রেণির মানুষের কাছে অসহ্য। ইসলামের দুশমনদের কাছে তারা বিক্রি হয়ে গেছে। তাদের এজেন্ডাই আজ এরা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে।
হে আল্লাহ! এ অবস্থা থেকে তুমি মুসলমানদেরকে হেফাজত করো। আমিন। ৩০/১০/২০১৫
দারসুল কুরআন ইসলাম সম্পর্কে জানার অন্যতম মাধ্যম। আশা করি সূরা হুমাযাহ এর দারস থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পেরেছি।
Comments
Post a Comment