Skip to main content

আল্লাহর সুন্নাত

 বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম

সুন্নাত বলতে এখানে নিয়ম বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ এই বিশ্বসাম্রাজ্য পরিচালনার ক্ষেত্রে আল্লাহপাকের একটি নিয়ম রয়েছে যেটাকে বলা হয় প্রাকৃতিক নিয়ম বা ইংরেজিতে Natural law। সুন্নাত শব্দটি কুরআন মজিদে বিভিন্নভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। সুরা বনি ইসরায়েলের ৭৭ নং আয়াতে 'তোমার আগে আমি যত নবি-রসুল পাঠিয়েছিলাম তাদের ব্যাপারে এই ছিল আমার নিয়ম (সুন্নাত), আর তুমি আমার নিয়মের (সুন্নাতের) কখনো রদবদল পাবে না।' এই প্রাকৃতিক নিয়ম আল্লাহর সৃষ্ট কিন্তু তিনি নিজে এই নিয়মের অধীন নন। এর ব্যতিক্রম, সেটি আল্লাহরই হুকুম। মূলত আল্লাহ সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক অর্থাৎ চরম ক্ষমতা বলতে যা বোঝায় তা আল্লাহরই রয়েছে। দুনিয়ার সবাইকে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হয় কিন্তু আল্লাহ এমন এক সত্তা যাঁকে কারো নিকট জবাবদিহি করতে হয় না; এমনকি পরামর্শও গ্রহণ করতে হয় না। তিনি স্বয়ংসম্পূর্ণ।

মানুষের জন্ম, বেড়ে উঠা, তার শৈশব, কৈশোর, যৌবন, বার্ধক্য, মৃত্যু সবই আল্লাহর দেয়া নিয়মের অধীন। আবার ক্ষুধা লাগলে খাবারগ্রহণ, পিপাসার্ত হলে পানিপান এবং প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নির্দিষ্ট কাজ করে তাও আল্লাহর নিয়মের অধীন- এই অর্থে সবই মুসলিম (অনুগত)। চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র, গাছপালা, জীব-জানোয়ার, পশু-পাখী আল্লাহর নিয়মের বাইরে কেউ নেই, এরাও মুসলিম। সৃষ্টির ধর্মই হলো ইসলাম এবং সবাই মুসলিম। এটি গেল একটি দিক, এদের মুসলিম না হয়ে কোনো উপায়ও নেই। কুফুরি করার ক্ষমতা কেবল মানুষ ও জিনেরই রয়েছে। মানুষকে স্বাধীন এখতিয়ার দিয়ে প্রতিনিধিত্ব করার দায়িত্ব আল্লাহই দিয়েছেন। একারণেই মানুষ আল্লাহর সেরা সৃষ্টি। মানুষকে জ্ঞান, বিবেক-বুদ্ধি ও ভালো-মন্দ যাচাইয়ের ক্ষমতা দান করা হয়েছে এবং ভালো-মন্দ তার সম্মুখে স্পষ্টও করা হয়েছে। তার বিবেকবোধ বলে দেয় কোনটি ন্যায় এবং কোনটি অন্যায়। তারপরও হেদায়াতের জন্য নবি-রসুল ও কিতাব দান করেছেন। মানুষের মধ্যে আল্লাহর দেয়া হেদায়াত অনুসারে যারা চলে তারা নৈতিক দিক দিয়ে মুসলিম। তাদের জন্যই রয়েছে জান্নাতের সুসংবাদ।

সকল সৃষ্টির রিজিকের দায়িত্ব আল্লাহর। তাঁর বাণী, কতো জীব-জানোয়ারই না এমন রয়েছে, যারা তাদের রিজিক বহন করে চলে না, আল্লাহ তায়ালাই তাদের রিজিক দেন, তোমাদের রিজিকও তিনি দেবেন, তিনি সবকিছু শোনেন এবং সবকিছু জানেন- সুরা আনকাবুত ৬০। এই রিজিক বন্টনের ক্ষেত্রে আল্লাহর একটি নিয়ম রয়েছে। মানুষ রিজিক অনুসন্ধান করবে এবং আল্লাহর কাছে চাইবে। আমরা বাস্তবেও দেখি, চেষ্টা-প্রচেষ্টায় যে যতো অগ্রগামী তার চাকরি, ব্যবসা ও খেতখামারে ততবেশি অগ্রগতি। এক্ষেত্রে নারী-পুরুষ, মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সকলকে আল্লাহপাক দিয়ে থাকেন। এটি আল্লাহর সাধারণ নিয়ম। রিজিক তালাশের জন্য আল্লাহ নিজেও বলেছেন, অতঃপর যখন নামাজ শেষ হয়ে যাবে তখন তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশ করো, আর আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করো, আশা করা যায় তোমরা সাফল্য লাভ করতে পারবে- সুরা জুমা ১০। সকল ইবাদতের পূর্বশর্ত হালাল উপার্জন। আমরা পরিশ্রমের পরিবর্তে রিজিকের প্রশস্ততার জন্য দোয়া তালাশ করি। এই দোয়া আল্লাহর সাথে বান্দার সম্পর্ক বাড়ায় কিন্তু রিজিকের প্রশস্ততার জন্য কঠোর পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই। পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি।

রিজিক প্রসঙ্গে রসুলুল্লাহ সা.-এর শিক্ষা আমাদের সম্মুখে রয়েছে। জনৈক ব্যক্তি সাহায্যের জন্য তাঁর কাছে আসলে তিনি জানতে চান, তোমার ঘরে কি কিছু রয়েছে? এঘটনা আমাদের পাঠ্য বইয়ে নবির শিক্ষা কবিতায় পড়েছি। তিনি আরো বলেছেন, উপরের হাত নিচের হাত অপেক্ষা উত্তম। যার ঘরে একদিনের খাবার রয়েছে তার জন্য ভিক্ষা করা জায়েজ নয়। হজরত ওমর রা. বলেন, যে কাজ করে না তার খাওয়া অন্যায়। আল্লাহ ও তাঁর রসুল সা.-এর এতো শিক্ষার পরেও এক কর্মবিমুখ জাতিতে পরিণত হয়েছি আমরা।

ইউরোপ-আমেরিকা-জাপান-চীন যাদেরকে আমরা কাফের-মুশরিক বলি তারা আজ উন্নতির শীর্ষে। এর মূলে রয়েছে তাদের পরিশ্রমপ্রিয়তা। আমরা কর্মঘন্টা কমানোর জন্য আন্দোলন করি, জাপানিরা তার বিপরীত। আল্লাহপাক কারো শ্রমকে বৃথা যেতে দেন না। শ্রমের মূল্যদান আল্লাহরই সুন্নাত (নিয়ম)। আজকে শুরু হতে যাচ্ছে বিসিএস প্রিলিমিনিয়ারি পরীক্ষা। বিপুল পরিমাণ ছাত্র-ছাত্রী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করছে। নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে যারা পড়াশোনা করেছে এবং কঠোর পরিশ্রম করেছে ও ধৈর্য ধারণ করে বারবার চেষ্টা করেছে সাফল্য তাদেরকেই ধরা দেবে। পরিশ্রম ছাড়া, সাধনা ছাড়া আল্লাহর কাছে চাওয়া অর্থ বিয়ে না করে সন্তান কামনা করা। পরিশ্রম ছাড়া আল্লাহ দিতে পারেন, কিন্তু এটি আল্লাহর সাধারণ নিয়মের বাইরে। একটি পাখিও বাসায় চুপ করে বসে থাকে না, বরং বাসা থেকে বেরিয়ে আল্লাহর জমিনে বিচরণ করে।

রিজিক তালাশের ক্ষেত্রে আল্লাহপাক বেশি বেশি করে তাঁকে স্মরণের কথা বলেছেন। এই স্মরণ কি কাজের মাঝে আল্লাহু আল্লাহু জিকির করা। না, মোটেই তা নয়। বরং ব্যবসায়ী ওজনে কম দেবে না, ভেজাল দেবে না, ধোঁকা-প্রতারণার আশ্রয় নেবে না এককথায় আল্লাহকে ভয় করে সবধরনের হারাম থেকে নিজেকে বিরত রাখবে। চাকরিজীবী জনগণের ভোগান্তির কারণ হবে না, যে কাজ দশ মিনিটে হওয়া সম্ভব তার জন্য মোটেই আধা ঘন্টা লাগাবে না। হাতে ঘুষ না নিয়ে কর্মচারীর মাধ্যমে নেয়া (কর্মচারী বলে, আমার স্যার নিজ হাতে ঘুষ নেয় না) নিছক ভণ্ডামি ছাড়া আর কিছু নয়। ঘুষখোরের নামাজ, রোজা, হজ-জাকাত, মসজিদনির্মাণ সবই মূল্যহীন- এসব তার মুখের ওপর ছুঁড়ে মেরে জাহান্নামের দিকে ঠেলে দেয়া হবে। রাস্তায় চলতে গিয়ে হাতে তসবিহ নিয়ে ঘুরাঘুরি করা জিকির নয়, জিকির হলো দৃষ্টি সংযত রাখা, রাস্তায় কষ্টদায়ক কিছু পেলে সেটি সরিয়ে দেয়া এবং পরিচিত-অপরিচিত নির্বিশেষে সালাম বিনিময় করা। রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক জিনিস সরিয়ে দেয়ার মধ্যে ক্ষমাপ্রাপ্তির কথা হাদিসে উল্লেখ পাওয়া যায়।

ছুবহান আল্লাহ, আলহামদু লিল্লাহ, আল্লাহু আকবার বলা, আয়াতুল কুরসি পাঠ, সুরা ফালাক-নাস পড়া- এসব জিকিরও খুবই মূল্যবান। প্রতি ফরজ নামাজান্তে, রাতে ঘুমানোর পূর্বে পাঠ করা এবং রসুলুল্লাহ সা. সকল কাজের শুরুতে বিসমিল্লাহ বলা এবং বিভিন্ন কাজে কখনো আলহামদু লিল্লাহ, কখনো ছুবহান আল্লাহ ও বিভিন্ন দোয়া শিখিয়েছেন। মুসলমানদের অন্তরে সবসময় জাগরুক থাকবে আল্লাহর স্মরণ ও ভয়- যাতে সবধরনের নাফরমানি থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারে। যে জিকির মানুষকে আল্লাহর নাফরমানি থেকে দূরে রাখতে পারে না সেটি কোনো জিকিরই নয়, হতে পারে একটি স্নায়বিক ব্যায়াম মাত্র।

রিজিক বন্টনের ক্ষেত্রে আল্লাহপাক কাউকে পরিমিত পরিমাণে আবার কাউকে বেহেসেবি দান করেছেন। এই কমবেশি করাটাও আল্লাহর হেকমত। যাদেরকে বেশি দিয়েছেন সেটি আল্লাহর অনুগ্রহের সাথে বাড়তি দায়িত্বও বটে। মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে তাঁর পক্ষে কখনো আব্দুর রাজ্জাক, কখনো আব্দুল হাকিম, কখনো আব্দুর রব, কখনো আব্দুল মালেক হয়ে দায়িত্ব পালন করবে। আল্লাহর বাণী, তোমাদের ধনসম্পদে বঞ্চিত ও প্রার্থীদের হক রয়েছে- সুরা আয যারিয়াত ১৯। ধনীরা দরিদ্রদের যা কিছু দান করে তা গরীবের হকটাই মূলত আদায় করে। এটি প্রাকৃতিক নিয়ম নয়, এটি মূলত আল্লাহর পক্ষ থেকে নৈতিক বিধান এবং এই নৈতিক বিধান সম্পর্কেই তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে।

আল্লাহপাক প্রদত্ত নৈতিক বিধান যা নবি-রসুলের মাধ্যমে দান করা হয়েছে তা বাস্তবায়ন করাই ইমানদারদের মৌলিক দায়িত্ব। আল্লাহর বাণী, তোমরা দ্বীন কায়েম করো- সুরা আশ শুরা ১৩। এই দ্বীন কায়েমই প্রতিনিধি হিসেবে বান্দার প্রধান দায়িত্ব এবং দ্বীন ইসলামের মধ্যে রয়েছে মানুষের ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক সকল সমস্যার সমাধান। এই দায়িত্ব পালনে তৎপরতা বান্দাকে জান্নাতে নিয়ে যাবে এবং অবহেলা-উপেক্ষা ও বিরোধীতার কারণে তার সকল আমল বরবাদ হয়ে যেতে পারে। দ্বীন ইসলামকে মেনে নেয়া, পালন ও প্রতিষ্ঠার চেষ্টা-প্রচেষ্টাকারী নৈতিক দিক দিয়ে মুসলিম (আত্মসমর্পণকারী)। আখেরাতে এটিরই বিচার হবে।

পৃথিবী শাসনের ব্যাপারে আমরা আল্লাহপাকের সুন্নাত সম্পর্কে একটু চিন্তা করতে পারি। রাজত্ব দেয়া ও কেড়ে নেয়ার ক্ষমতা আল্লাহর। তাঁর বাণী, (হে নবি), তুমি বলো, হে রাজাধিরাজ (মহান আল্লাহ), তুমি যাকে ইচ্ছা তাকে সাম্রাজ্য দান করো, আবার যার কাছ থেকে চাও কেড়েও নাও, যাকে ইচ্ছা তুমি সম্মানিত করো, যাকে ইচ্ছা তুমি অপমানিত করো; সব রকমের কল্যাণ তো তোমার হাতেই নিবদ্ধ; নিশ্চয়ই তুমি সবকিছুর ওপর একক ক্ষমতাবান- আলে ইমরান ২৬। এব্যপারে তাঁর একটি নিয়ম রয়েছে। জমিনে ইমানদার জনগোষ্ঠী যোগ্যতার সাথে সক্রিয় থাকলে তাদেরকে বাদ দিয়ে কাফের-মুশরিককে রাজত্ব দেয়া স্বাভাবিক নয়।

মুহাম্মদ সা.-এর অনুসারীদের সম্পর্কে আল্লাহর উক্তি বড়ই তাৎপর্যপূর্ণ, 'তোমাদেরকে শ্রেষ্ঠতম উম্মত হিসেবে সৃষ্টি করা হয়েছে মানবজাতির কল্যাণের উদ্দেশ্যে, তোমরা মানুষকে ভালো কাজের আদেশ দিবে এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখবে'- সুরা আলে ইমরান ১১০। এখানে আল্লাহপাক আদেশ দানের কথা বলেছেন। আদেশ দান তারাই করতে পারে যাদের হাতে সমাজের কর্তৃত্ব থাকে। উপলব্ধি করা যায়, আল্লাহ তায়ালা তাঁর বিশ্বাসী বান্দাদের সমাজে নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের আসনে দেখতে চান। আমরা আর আদেশ দানের পর্যায়ে নেই, কাফের-মুশরিকদের আদেশানুগত। আমাদের প্রতি আল্লাহর কোনো বিদ্বেষ নেই বরং আল্লাহর দৃষ্টিতে আমরা রাজত্ব করার মতো উপযুক্ত নই।

আল্লাহপাকের সুন্নাত হলো সমাজে যারা মানবকল্যাণে তৎপর, মানুষের সুখে-দুখে পাশে থাকে সমাজের নেতৃত্ব স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাদের হাতেই চলে আসে। মুহাম্মদ সা. তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তিনি সমাজবিচ্ছিন্ন কোনো মানুষ ছিলেন না। সমাজের মানুষের সুখে-দুখে তাদের পাশে থাকতেন, তাদের মালসামানের নিরাপদ সংরক্ষণকারী, বিবাদ-বিসংবাদের মীমাংসাকারী, আত্মীয়-স্বজন ও গরীব-দুখীর সাহায্যকারী এবং তাঁর সত্যবাদিতা, ওয়াদা-প্রতিশ্রুতি পালন ও আমানত সংরক্ষণে কেউ তাঁর জুড়ি ছিল না। সমাজে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ও নেতৃত্বের কারণে কাবা শরীফে কালো পাথর সরানো বিবাদে সবাই তাঁকে মীমাংসকারী মেনে নেয় এবং কাফের-মুশরিকদের প্রবল বিরোধীতা সত্ত্বেও তাঁর মিশন বন্ধ করা সম্ভব হয়নি।

বিশ্বকে শাসন করার মতো কোনো যোগ্যতাই বর্তমান মুসলমানদের নেই। নিজেদের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ, দলাদলি ও মতপার্থক্যে জর্জরিত আজকের মুসলিমরা। মৌলিক মানবীয় গুণ থেকে তারা বঞ্চিত। দেশে সুশাসন ও ইনসাফ নেই। আমাকে কেউ যদি জিজ্ঞেস করে, আপনার দৃষ্টিতে সবচেয়ে বড় অপরাধ কোনটি? আমি বিনা দ্বিধায় বলবো, অবৈধভাবে জনগণের ঘাড়ে চেপে বসা অর্থাৎ জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া শাসক হওয়া। অধিকাংশ মুসলিম দেশে রয়েছে রাজতান্ত্রিক স্বৈরশাসন, সামরিক স্বৈরশাসন ও নির্বাচন ব্যবস্থা ভণ্ডুল করে যেনতেনভাবে মানুষকে শাসন করা। সুবিচারপূর্ণ শাসন না থাকায় হত্যা-গুম-সীমাহীন দুর্নীতি ও মানুষের প্রতি চরম জুলুম-নির্যাতন চলছে।

পক্ষান্তরে বর্তমানে বিশ্বকে যারা শাসন করছে তাদের দিকে দৃষ্টিপাত করলে আমরা দেখবো তারা নিজেদের দেশে সুশাসন কায়েম করেছে, জনকল্যাণে তৎপর, নির্বাচন ব্যবস্থা অত্যন্ত স্বচ্ছ এবং ক্ষমতার পালাবদলে কোনো হাঙ্গামা নেই। আমার দৃষ্টিতে একটি ক্ষেত্রেই তাদের দুর্বলতা, সেটি হলো তাদের উচ্ছৃঙ্খল যৌনজীবন। অশ্লীলতা, বেহায়াপনা লুত আ.-এর কওমকেও তারা ছাড়িয়ে গেছে। এটি ঠিক, মুসলিম বিশ্বে যে হত্যাযোগ্য তার মূল হোতা এ-সব পরাশক্তির অধিকারীরা। আমার মনে হয়, কোরআনের ধারক ও নবির উত্তরাধিকার হওয়া সত্ত্বেও এতবড় নেয়ামতের অকৃতজ্ঞতার শাস্তিস্বরূপ কাফের-মুশরিকদের দ্বারা আল্লাহপাক আমাদেরকে শাস্তি দিচ্ছেন। এতকিছুর পরও আমাদের শিক্ষা নেই। কাফের-মুশরিকরাই আমাদের বন্ধু এবং তাদেরই প্ররোচনায় ইমানদারদের প্রতি চালানো হচ্ছে সীমাহীন জুলুম-নির্যাতন। এতো দুনিয়ার জীবনের জিল্লতি, আল্লাহর ভাষায় আখেরাতে রয়েছে কঠোরতম আজাব।

আল্লাহপাক তাঁর বান্দাদেরকে তাঁর কাছে চাওয়ার জন্য বলেছেন। বান্দাদের প্রয়োজন পূরণ তাঁর দায়িত্ব। তাঁর বাণী, আর হে নবি! আমার বান্দারা যদি তোমার কাছে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে, তাহলে তাদেরকে বলে দাও, আমি তাদের অতি নিকটে। যে আমাকে ডাকে আমি তার ডাক শুনি এবং জবাব দেই, কাজেই আমার আহবানে সাড়া দেয়া ও আমার প্রতি ইমান আনা তাদের একান্ত কর্তব্য। একথা তুমি তাদের শুনিয়ে দাও, হয়তো তারা সত্য-সরল পথের সন্ধান পাবে- সুরা বাকারা ১৮৬। এখানে আল্লাহপাক স্পষ্ট করেছেন, বান্দা যখন তাঁকে ডাকে তিনি শুনেন অর্থাৎ তিনি বধির নন এবং বান্দা থেকে দূরেও নন। ডাক শুনেই তিনি ক্ষান্ত হন না বরং বান্দার ডাকে জবাব দেন অর্থাৎ প্রয়োজন পূরণ করেন। আল্লাহরও চাওয়া রয়েছে, সেটি হলো তাঁর প্রতি ইমান আনা ও আনুগত্য করা। তিনি আরো বলেছেন, হে ইমানদারগণ! তোমরা ধৈর্য ও নামাজের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করো, নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন- সুরা বাকারা ১৫৩।

এখানে ইমানদারদের ডেকে বলেছেন, আল্লাহর কাছে চাওয়ার সর্বোত্তম মাধ্যম হলো নামাজ, বিশেষ করে বান্দা যখন সেজদায় যায় তখন আল্লাহর খুব নিকটবর্তী হয়ে পড়ে। বান্দা যখন সুন্নাত-নফল নামাজ আদায় করেন, তখন সে যেন তার সব প্রয়োজন আল্লাহর কাছে পেশ করেন- তার সুস্থতা, রিজিক, ভালো চাকরি, ব্যবসায়ে সাফল্য, চোখজুড়ানো স্বামী/স্ত্রী ও সন্তানাদি- এককথায় যা প্রয়োজন সবই তার রবের কাছে চাইবে। নাছোড়বান্দা হয়ে কেঁদে কেঁদে চাইবে যেমনটি শিশু তার মায়ের কাছে চায়। তার রব দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ; চাওয়া পূরণে বিলম্ব হলেও সে চাওয়া অব্যাহত রাখবে ও ধৈর্য অবলম্বন করবে। আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে রয়েছেন। আল্লাহর কাছে চাওয়ার মাধ্যমে বান্দার বিনয় প্রকাশ পায় এবং তিনি বান্দার প্রতি সন্তুষ্ট হন। কোনো কারণে বান্দার প্রার্থিত চাহিদা পূরণ না হলে বুঝতে হবে বান্দার জন্য সেটি কল্যাণকর নয় বলে আল্লাহ বিলম্ব করছেন বা মঞ্জুর করছেন না। কিন্তু তিনি তাঁর ধৈর্যশীল বান্দাকে আখেরাতে এতো পরিমাণ দেবেন যে বান্দা খুশি হয়ে বলবে, দুনিয়ায় কিছু না দিয়ে সবই যদি আল্লাহ আখেরাতে দিতেন; কতই না ভালো হতো।

আল্লাহ নামাজীদের সাথে আছেন একথা না বলে বলেছেন, আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন। সকল মানুষই আল্লাহর বান্দা এবং মুসলিম না হয়েও বান্দা তার রবের কাছে অবচেতন মনেই চেয়ে থাকে। যে বিজ্ঞানী গবেষণা করে এবং বছরের পর বছর গবেষণায় নিজেকে নিয়োজিত রাখেন, একসময় আল্লাহপাক তাকে সাফল্য দান করেন। ধৈর্য এক অসাধারণ গুণ। আল্লাহ ধৈর্য়শীলদের সাথে আছেন, একথার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায় যে, যারাই গবেষণা করে, চিন্তা-ভাবনা করে, লেগে থাকে এবং পরম ধৈর্য অবলম্বন করে আল্লাহ তাকে সাফল্য দান করেন। যত বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার- সবই আল্লাহপাকের অনুগ্রহ, বান্দার প্রতি আল্লাহর ইলহাম। একজন মুসলিম বিজ্ঞানীর গবেষণা বড়ধরনের ইবাদত। হাদিসে বলা হয়েছে, সৃষ্টি নিয়ে এক ঘন্টা গবেষণা করা ৭০ বছর ইবাদত অপেক্ষা উত্তম, রাতের একটি ক্ষুদ্র অংশ জ্ঞান অর্জন করা সারারাত জেগে ইবাদত অপেক্ষা উত্তম। জ্ঞানসাধনা ও গবেষণার প্রতি ইসলামের গুরুত্বপ্রদান বিষ্ময়কর। দুর্ভাগ্য, অজ্ঞতা ও মুর্খতা আজ মুসলমানদের মাঝে পেয়ে বসেছে। তারা আছে হিংসা-বিদ্বেষ ও ঝগড়াঝাটিতে ব্যস্ত।

আল্লাহর দেয়া নিয়মের ব্যতিক্রম, সেটি তাঁরই ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ এবং যেটিকে বলা হয় আল্লাহপাকের নিদর্শন। আগুনের ধর্ম পুড়িয়ে ফেলা, কিন্তু ইব্রাহিম আ.-কে না পোড়ানো আল্লাহর নিদর্শন। মাছের পেটে ইউনুস আ.-এর জীবিত থাকা, মুসা আ.-এর নদী পার হয়ে চলে যাওয়া এবং সেইপথে ফেরাউনের সদলবলে ডুবে মরা, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাখির আক্রমণে আবরাহার বিশাল হস্তিবাহিনীর ধ্বংস হয়ে যাওয়া- সবই আল্লাহপাকের নিদর্শন, এর কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই।

সম্প্রতি সুপারপাওয়ার আমেরিকা ও তার মিত্রবাহিনী থেকে আফগানিস্তানের বিজয়লাভ- এটিও আল্লাহর নিদর্শনসমূহের অন্যতম; মানুষের যুক্তি-বুদ্ধি দিয়ে এর ব্যাখ্যা পাওয়া কঠিন। দেড় বছর ধরে চলছে করোনা মহামারির তাণ্ডব। চীনে করোনার উত্থান এবং আশেপাশের গরীব ও চিকিৎসা সুবিধাবঞ্চিত দেশগুলোকে ছাড়িয়ে সুদূর ইউরোপ-আমেরিকাকে একযোগে আঘাতহানা- এটিও ব্যাখ্যাতীত। বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের মতামত ছিল, এখানে আটকোটি লোক আক্রান্ত হবে এবং বিশ লক্ষ মারা যাবে। আল্লাহপাক আমাদের প্রতি রহম করেছেন। শয়তানের প্ররোচনা ও বিশ্বাসহীনতার কারণে আল্লাহ তায়ালার নিদর্শনাবলী উপলব্ধি করতে আমরা ব্যর্থ হচ্ছি। আল্লাহপাক বিপদ-মুসিবত দিয়ে আমাদেরকে তাঁর কাছে ফিরে আসার সুযোগ করে দেন। তিনি আমাদেরকে তাঁর পথে চলাটা সহজ করে দিন। ৩০.১০.২১

 

Comments