Skip to main content

রসুলের সা. জীবনে রয়েছে তোমাদের জন্য আদর্শ

 

দরসুল কুরআন

এই লেখাটি সাপ্তাহিক সোনারবাংলা সিরাতুন্নবী সা. ২০২১ সংখ্যায় প্রকাশিত

তোমাদের জন্য অবশ্যই আল্লাহর রসুলের মাঝে উত্তম আদর্শ রয়েছে- এমন প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য যে আল্লাহর সাথে সাক্ষাত ও পরকালের (মুক্তির) আশা করে এবং বেশি করে আল্লাহকে স্মরণ করে- সুরা আহযাব ২১।

নামকরণ : ২০ নং আয়াতে উল্লিখিত আহযাব শব্দ দ্বারা সুরাটির নামকরণ করা হয়েছে।

নাজিলের সময়কাল : এখানে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিশেষ করে আহযাব যুদ্ধ যেটি সংঘটিত হয়েছে ৫ম হিজরির শাওয়াল মাসে, দ্বিতীয়ত জিলকদ মাসে সংঘটিত বনি কুরাইজার যুদ্ধ এবং একই মাসে সংঘটিত হজরত জয়নব রা.-এর সাথে নবি মুহাম্মদ সা.-এর বিয়ে উল্লেখ রয়েছে। এই সুরায় উল্লিখিত ঘটনাবলি এর নাজিলের সময়কাল বলে দেয়।

ঐতিহাসিক পটভূমি ও বিষয়বস্তু : তৃতীয় হিজরির শাওয়াল মাসে তিরন্দাজ বাহিনীর ভুলে ওহুদ যুদ্ধে মুসলমানদের পরাজয় ঘটে। এই পরাজয় আরবের মুশরিক, ইহুদি ও মুনাফিকসহ সকল কুফুরি শক্তির মধ্যে সাহস ও আশা সঞ্চার হয় যে, ইসলামের ওপর কুফুরি শক্তির বিজয়ী হওয়া সম্ভব। ফলে বিভিন্ন গোত্র নানাভাবে মুসলমানদের উত্যক্ত করতে থাকে। এই সময়ে দ্বীন শেখার ইচ্ছা প্রকাশ করে রসুলুল্লাহ সা.-এর নিকট বিভিন্ন গোত্রের পক্ষ থেকে মুবাল্লিগ (প্রচারক) চাওয়া হয়। রসুলুল্লাহ সা. সরল বিশ্বাসে তাঁর সাহাবাদের একাধিক দল পাঠান, কিন্তু তারা বিশ্বাসঘাতকতা করে তাঁদেরকে নির্মমভাবে শহীদ করে। এর মধ্যে বিরে মাউনাহর ঘটনা উল্লেখযোগ্য এবং এই দলের ৪০ জন (অন্য বর্ণনা মতে ৭০ জন) সাহাবিকে একসঙ্গে হত্যা করা হয়। বনি নজির ইহুদি গোত্রটি রসুলুল্লাহ সা.-কে হত্যা করার পরিকল্পনা করে। রসুলুল্লাহ সা. সকল খবরাখবর রাখতেন এবং সে-সময়ে চুক্তি ভঙ্গ ও বিশ্বাসঘাতকতা করার অপরাধে তাদের দমনের লক্ষ্যে তিনি একাধিক বাহিনী পাঠান।

৫ম হিজরির শাওয়াল মাসে আরবের সকল কুফুরি শক্তি একাট্টা হয়ে ক্ষুদ্র ইসলামী শক্তিকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে দশ-বারো হাজার লোকের বিশাল বাহিনী নিয়ে মদিনা আক্রমণ করে। সে-সময়ে মদিনা উত্তর-পশ্চিম দিক ছাড়া পর্বতমালা ও ঘন জঙ্গল দ্বারা সুরক্ষিত ছিল। শহরকে রক্ষা করার লক্ষ্যে সাহাবায়ে কেরামের সাথে পরামর্শক্রমে রসুলুল্লাহ সা. মাত্র ৬দিনে মদিনার উত্তর-পশ্চিম দিকে (যে পথ দিয়ে মদিনা আক্রমণ সম্ভব) পরিখা খনন করেন। কাফেররা এ অবস্থা দেখে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে এবং কয়েকদিন অবস্থানের পর তাদের রসদপত্রের ঘাটতি ও ব্যাপক ধুলিঝড়ের ফলে তাদের আশ্রয় ধ্বংস হয়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে তারা ফিরে যেতে বাধ্য হয়। এ-সময়ে মদিনার ইহুদি ও মুনাফিকদের ভূমিকা ছিল বড় ন্যাক্কারজনক। আহযাব যুদ্ধের পরে রসুলুল্লাহ সা. ঘোষণা করেন, ভবিষ্যতে আর কখনই কুরাইশরা তোমাদের ওপর আক্রমণ চালাতে পারবে না। আল্লাহপাকের নির্দেশক্রমে যুদ্ধের পোশাক না খুলেই তিনি বনি কুরাইজাকে আক্রমণ করেন এবং অবরোধের তিন সপ্তাহের মধ্যে তারা আত্মসমর্পণ করে। চুক্তির শর্ত মোতাবেক তাদের পুরুষ সদস্যদের হত্যা করা হয়।

এই সুরায় পর্দার বিধানসহ সামাজিক সংস্কারের নানা কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। বিশেষ করে তৎকালে পালক পুত্রকে নিজের পুত্র হিসেবে গণ্য করা হত। এই কুসংস্কার দূর করার জন্য আল্লাহপাক তাঁর রসুল সা.-কে পালক পুত্রের তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রী হজরত জয়নব রা.-কে বিয়ের নির্দেশ দেন। যুদ্ধের ডামাডোল এবং পালক পুত্রের স্ত্রীকে বিয়ে এরূপ নাজুক মুহূর্তে আল্লাহপাক বলেছেন, তোমাদের জন্য অবশ্যই আল্লাহর রসুলের মাঝে উত্তম আদর্শ রয়েছে- রসুল আল্লাহ কর্তৃক মনোনীত এবং আল্লাহর নির্দেশ বাস্তবায়নে তিনি অনুকূল-প্রতিকূল কোনো কিছুর বাছ-বিচার করেন না। আর মোমিনদের উচিত শর্তহীনভাবে তাঁকে মেনে নেয়া।

ব্যাখ্যা : এই ২১ নং আয়াতটি তৎকালে ইমান, ইসলাম ও রসুল সা.-এর আনুগত্যের দাবীদারদের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে, এই কঠিন মুহূর্তে রসুলু সা.-এর গৃহিত কর্মনীতি ছিল তোমাদের জন্য আদর্শ। সে-সময়ে তিনি নিজে নির্দেশ দিয়েই ক্ষান্ত হননি বরং তাঁর সঙ্গী-সাথীদের সাথে সীমাহীন কষ্ট ভোগ করেছেন। নিষ্ঠাবান মোমিনরা আন্তরিকভাবে তাঁর সকল নির্দেশ মেনে চলেছেন। আল্লাহর পথে জীবন দেয়ার মাঝে তাঁরা সার্থকতা দেখেছেন। কিন্তু যাদের মাঝে সন্দেহ-সংশয় ছিল তারা নানাভাবে পাশকেটে চলার চেষ্টা করেছিল। আল্লাহর এই বাণীর অর্থ এতটুকুর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এই বাক্যটি ব্যাপক অর্থবোধক এবং কেয়ামত পর্যন্ত মুসলমানদের জন্য মুহাম্মদ সা. হলেন আদর্শ ও শর্তহীনভাবে তাঁকে মেনে চলার নির্দেশই এখানে প্রদান করা হয়েছে।

মানুষের হেদায়াতের জন্য আল্লাহপাক তাদের মধ্য থেকে রসুল মনোনীত করেন এবং যিনি রসুল হিসেবে মনোনীত হন তিনি তাঁর অনুসারীদের জন্য আদর্শ। আদম আ. প্রথম মানুষ ও নবি এবং দুনিয়ায় আসার সময় ভীত-সন্ত্রস্ত আদম আ.-কে আল্লাহপাক অভয়বাণী শুনিয়েছিলেন, আমার পক্ষ থেকে যে হেদায়াত যাবে যারা তা অনুসরণ করবে তাদের কোনো ভয়ের কারণ নেই- সুরা বাকারা ৩৮। অসংখ্য নবি-রসুলের মধ্যে প্রিয়তম নবি মুহাম্মদ সা. হলেন সর্বশেষ নবি ও রসুল। মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে আল্লাহর গোলামী করার জন্য এবং গোলামী করার পন্থা বলে দিয়েছেন তাঁর মনোনীত রসুলগণ।

আল্লাহপাক তাঁর আনুগত্যের সাথে তাঁর মনোনীত রসুলদের আনুগত্য ফরজ করেছেন এবং রসুলের আনুগত্যের মাধ্যমেই কেবল আল্লাহর ভালোবাসা প্রাপ্তি সম্ভব। আল্লাহর বাণী, (হে নবি) তুমি বলো, তোমরা যদি আল্লাহ তায়ালাকে ভালোবাসো, তাহলে আমার কথা মেনে চলো, আল্লাহ তায়ালাও তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তিনি তোমাদের গুনাহখাতা মাফ করে দেবেন; আল্লাহ তায়ালা অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও দয়াবান- সুরা আলে ইমরান ৩১। আল্লাহপাকের দাসত্ব ও আনুগত্যের প্রকৃষ্ঠ উদাহরণ হলেন নবি মুহাম্মদ সা.।

ইমানের অন্যতম শর্ত হলো মুহাম্মদ সা.-কে রসুল হিসেবে মেনে নেয়া এবং এই মেনে নেয়ার পরে তাঁর আনুগত্যের বাইরে একজন মুসলমানের আলাদা কোনো জীবন নেই। আল্লাহর সাথে যারা সাক্ষাত ও পরকালের মুক্তি প্রত্যাশা করে তাদের জন্য মুহাম্মদ সা.-এর জীবন হলো উত্তম আদর্শ এবং এর বাইরে মুক্তির কোনো পথ খোলা নেই। আল্লাহ তায়ালার দাবী, তোমরা পরিপূর্ণ ইসলামে দাখেল হয়ে যাও এবং কোনো অবস্থায়ই শয়তানের পদাংক অনুসরণ করো না; সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু- বাকারা ২০৮। অর্থাৎ মুহাম্মদ সা.-কে খণ্ডিতভাবে নয় পরিপূর্ণভাবে মানতে হবে। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনীতিক সকল ক্ষেত্রে মুহাম্মদ সা. মোমিনদের জন্য আদর্শ। সামান্যতম বিচ্যুতি অর্থ শয়তানের আনুগত্য। আর শয়তান হলো মানুষের বড় দুশমন।

মুহাম্মদ সা. ছিলেন একজন মানুষ এবং আল্লাহপাক মানুষের মধ্য থেকেই নবি বাছাই করেন। নবি হিসেবে তিনি যা করেছেন, বলেছেন, অনুমোদন দিয়েছেন তা সবই মোমিনদের জন্য অনুকরণীয়। শর্তহীনভাবে রসুল সা.-কে অনুসরণ করতে হবে। এই অনুসরণের ক্ষেত্রে কোনো বিভক্তি আনা যাবে না। অর্থাৎ ধর্মীয় জীবনে রসুলুল্লাহ সা.-কে অনুসরণ করবে কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্য, সামাজিক-রাজনীতিক জীবনে অন্য কাউকে আদর্শ মানবে, এমন কোনো সুযোগ নেই। আল্লাহর স্পষ্ট ঘোষণা, রসুলের মাঝে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ রয়েছে- এটা জানার পরও তারা তাদের নবি সা.-কে একমাত্র আদর্শ হিসেবে না মেনে অন্য কারো মধ্যে আদর্শ তালাশ করে ও তাকে মেনে চলে; মুসলিম উম্মাহর জন্য এটি বড় দুর্ভাগ্য।

মুহাম্মদ সা. সকলের জন্য আদর্শ এবং তাঁকে মেনে চলার মধ্যেই রয়েছে ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজের কল্যাণ। আহার, নিদ্রা, চলাফেরা একান্ত ব্যক্তিগত জীবনে তাঁর জীবনাচার- সবই উম্মাহর জন্য আদর্শ ও কল্যাণকর। তিনি ছিলেন আদর্শ স্বামী, আদর্শ পিতা, আদর্শ প্রতিবেশী, আদর্শ শাসক, বিচারক, সেনানায়ক সকল ক্ষেত্রেই তিনি আদর্শ এবং তাঁকে মেনে চলে সকলেই উপকৃত হবে। স্বামী হিসেবে স্ত্রীর অধিকার আদায়ে তিনি ছিলেন অগ্রগামী। তিনি তাঁর উম্মতদেরও সতর্ক করেছেন, তোমাদের মধ্যে ঐ উত্তম যে তার স্ত্রীর নিকট উত্তম। স্বামী সম্পর্কে কেয়ামতের দিন স্ত্রীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হবে। পাশাপাশি দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে তিনি নারীদেরকেও সতর্ক করেছেন এই বলে যে, স্বামীর সংসারে স্ত্রীর জিম্মাদারী সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। নারীদের দায়িত্বও তিনি হালকা করে দিয়েছেন। নামাজ-রোজার মতো মৌলিক ইবাদত পালনের সাথে স্বামীর হুকুম পালনকারী স্ত্রী সম্পর্কে বলেছেন, সে যে দরজা দিয়ে খুশি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে। ঐ স্ত্রী উত্তম যে স্ত্রীকে দেখে স্বামী প্রশান্তি লাভ করে।

রসুলুল্লাহ সা. আদর্শ পিতা হিসেবে ছিলেন অনন্য। তাঁর পুত্রগুলো অতি শৈশবে ইন্তেকাল করেন। মেয়েদেরকে স্নেহ-আদর দিয়ে গড়ে তুলেছেন। তিনি বলেছেন, যে ব্যক্তি তার কন্যাদের সাথে সদাচরণ করবে, ভালোভাবে মানুষ করবে ও সৎপাত্রে পাত্রস্থ করবে কেয়ামতের দিন তার ও আমার অবস্থান হবে একত্রে। সুপ্রতিবেশী হিসেবে তিনি নিজে যেমন ছিলেন উদাহরণ তেমনি তাগিদও দিয়েছেন। ঐ ব্যক্তি মোমিন নয় যার অনিষ্ট থেকে তার প্রতিবেশী নিরাপদ নয়। প্রতিবেশীকে অভুক্ত রেখে নিজে উদরপূর্তি করে খাওয়াকে মোমিনের পরিচায়ক নয় বলে জানিয়েছেন। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত এবং সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত সামগ্রিক জীবন পরিচালনার ক্ষেত্রে আমরা রসুলুল্লাহ সা.-এর দিকনির্দেশনা পেয়ে থাকি। অর্থাৎ আমাদের আহার-নিদ্রা, পেশাব-পায়খানা, ওজু-গোসল, স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততির সাথে আচরণসহ জীবনের সকল অবস্থায় একজনকে মানা যায়, তিনি হলেন আমাদের প্রিয়তম নবি মুহাম্মদ সা.।

রসুলুল্লাহ সা.-কে আদর্শ হিসেবে মানার ক্ষেত্রে আমরা খেয়াল করি কেবল আমাদের পোশাক-পরিচ্ছদ, দাঁড়ি-টুপি এবং নামাজ-রোজার মতো আনুষ্ঠানিক ইবাদত পালনের ক্ষেত্রে। এর বাইরে রসুল সা.-কে মানার ব্যাপারে আমরা বড় উদাসীন। নামাজ আদায়ের ক্ষেত্রে মাসালা বিষয়ে স্বয়ং রসুলুল্লাহ সা.-এর আমলের মাঝে ভিন্নতা ছিল। এই ভিন্নতা দ্বীন পালনের ক্ষেত্রে সহজতা বিধানের জন্য এবং এগুলি সবই কম গুরুত্বপূর্ণ (মুস্তাহাব) বিষয়। অথচ এসব নিয়ে মুসলমানদের নানা দল-উপদল, এক অপরকে কাফের আখ্যা দেয়া এবং পৃথক মসজিদ গড়ে তোলা পর্যন্ত হয়ে থাকে। এমন আচরণের পেছনে জ্ঞানের স্বল্পতা ও হিংসা-বিদ্বেষ ছাড়া আর কিছু নেই। অথচ হিংসা পোষণকারী অত্যন্ত ঘৃণ্য এবং তার সকল আমল বরবাদ হয়ে যায় বলে হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে। হাদিসে উল্লেখ রয়েছে যে, বিশেষ বিশেষ দিনে আল্লাহর অগণিত বান্দাকে ক্ষমা করা হয় কিন্তু যার মধ্যে শিরক ও হিংসা রয়েছে সে এই ক্ষমার বাইরে থাকে।

নবুয়ত লাভের পর থেকেই রসুলুল্লাহ সা. আল্লাহর নির্দেশক্রমে (সুরা মুদ্দাসসিরে নির্দেশ দিয়েছেন) মানুষকে দাওয়াত দিতে থাকেন। তাঁর দাওয়াতের মূল বিষয় ছিল তাওহিদ, রেসালাত ও আখেরাত। সকলকে অস্বীকার করে আল্লাহ তায়ালাকে একমাত্র ইলাহ (লা ইলাহা ইল্লাহ) হিসেবে মেনে নেয়ার জন্য তিনি মানুষকে উদাত্ত আহবান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আল্লাহকে ইলাহ ও তাঁকে রসুল হিসেবে মেনে নিলে মানুষ দুনিয়া ও আখেরাতে কল্যাণ লাভ করবে। যারা মুসলিম দাবীদার তারা সবাই আল্লাহকে ইলাহ মানে কিন্তু সাথে সাথে আরো ইলাহ মানে- সেটি হতে পারে নিজের প্রবৃত্তি বা নফস, জিন শয়তান ও মানব শয়তান এবং বাপ-দাদা থেকে চলে আসা রুসুম-রেওয়াজ। কালেমা তাইয়্যেবার উচ্চারণের মাধ্যমে সবকিছু অস্বীকার করে সে কেবল আল্লাহকে মানার অঙ্গীকার করে। আল্লাহর বাণী, তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো এবং তাগুতকে অস্বীকার করো- সুরা আন নাহল ৩৬।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, রসুল প্রেরণের উদ্দেশ্য কী? এব্যাপারে আল্লাহপাক দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছেন, সকল জীবনব্যবস্থার ওপর আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করা- এ প্রসঙ্গে কোথাও বলা হয়েছে শিরকবাদীগণ মোটেই বরদাশত করবে না/আবার বলা হয়েছে আল্লাহর সাক্ষই যথেষ্ট (সুরা তওবা-৩৩, ফাতহা-২৮ ও সফ-৯)। আমাদের প্রিয়তম নবি মুহাম্মদ সা.-এর সকল কর্মকাণ্ড ছিল দ্বীন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। তাঁর অনুসারী হিসেবে আমাদেরও দায়িত্ব একই। এই দায়িত্ব পালনে অবহেলা করে কেউ রসুল সা.-এর যথার্থ অনুসারী হতে পারে না। মুহাম্মদ সা. ছিলেন সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী। জাতির সবচেয়ে কল্যাণকামী, তাঁকে উপাধী দেয়া হয়েছিল আল আমিন, আস সাদিক। অথচ এই মানুষটি যখন ঘোষণা দিলেন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ তখনই তাঁর ওপর সবাই হামলে পড়ে। এটি ছিল এক বিপ্লবাত্মক ঘোষণা- এই ঘোষণায় শাসক ও শোষকগোষ্ঠী নিজেদের ধ্বংস উপলব্ধি করে। শুধু মুহাম্মদ সা.-এর ক্ষেত্রেই নয় অতীতকালের সকল নবি-রসুল যেমন, নুহ আ., ইব্রাহিম আ., মুসা আ.সহ সকলকে একই পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছে। নবি-রসুলদের সাথে সমসাময়িক শাসকগোষ্ঠীর বিরোধের মূল কারণ ছিল রাজনীতিক। নমরুদ-ফেরাউনসহ সকল স্বৈরশাসক ইবরাহিম আ. ও মুসা আ.সহ নবি-রসুলদেরকে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করতো এবং বিশ্বাস করতো যে, এইসব নবি-রসুলগণ তাদেরকে ক্ষমতাচ্যুত করবে। ইসলাম ও কুফরের দ্বন্দ্ব মূলত এখানেই। যারা তাগুতকে অস্বীকার করে আল্লাহকে এককভাবে মানতে চান তাদের ইসলাম প্রচারকে বিশ্বের তাগুতি শক্তি নাম দিয়েছে পলিটিক্যাল ইসলাম এবং এর মোকাবেলায় তাগুতের সমর্থনপুষ্ট তথাকথিত সহীহ ইসলামকে তারা সহযোগিতা করছে।

আল্লাহর সাথে সাক্ষাত ও পরকালে মুক্তির প্রত্যাশী এবং বেশি করে আল্লাহকে স্মরণকারী ব্যক্তি দ্বীন প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব পালন থেকে নিজেকে মুক্ত ভাবতে পারে না। দ্বীন প্রতিষ্ঠা বা জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর কথা উচ্চারণ হলে এক শ্রেণির মানুষ সন্ত্রাসের গন্ধ খুঁজে। সন্ত্রাসের সাথে জিহাদের কোনো সম্পর্ক নেই। জিহাদ একটি ইবাদত যার অর্থ নিরলস প্রচেষ্টা অর্থাৎ আল্লাহর কালিমাকে বুলন্দ করার জন্য অব্যাহত প্রচেষ্টা। মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকা, ইসলামের আলোকে নিজেদেরকে পরিশুদ্ধ করা বা চরিত্র গঠন জিহাদের মৌলিক কাজ। আল্লাহপাক প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, ইমান ও নেক আমলে সমৃদ্ধ একদল জনগোষ্ঠী জমিনে সক্রিয় থাকলে তিনি তাদেরকে খেলাফত দান করবেন (সুরা নুর ৫৫)। এজন্য প্রয়োজন মানুষের সম্মুখে ইসলামকে সহজভাবে উপস্থাপন করা। রসুলুল্লাহ সা. দীর্ঘ তেরোটি বছর মক্কায় সকল প্রতিকূল অবস্থা মাড়িয়ে মানুষকে আল্লাহর দিকে ডেকেছেন। একতরফাভাবে তিনি নিজে ও তাঁর সাহাবিরা নির্যাতিত হয়েছেন। কখনো পাল্টা আঘাত হানেননি। আল্লাহপাকের নির্দেশনাও ছিল ধৈর্য অবলম্বনের। কুরআন মজিদে পূর্ববর্তী নবিদের যে ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে তাতে একই চিত্র লক্ষণীয়। জালেমকে শক্তহাতে ধরেছেন স্বয়ং আল্লাহ। নমরুদ, ফেরাউন, আবরাহার মতো স্বৈরশাসককে আল্লাহই ধ্বংস করেছেন। কুরআন অধ্যয়ন ও রসুলুল্লাহ সা.-এর জীবন আলোচনা করলে দেখা যায় বিচ্ছিন্ন কোনো ব্যক্তি, দল বা গোষ্ঠীর যুদ্ধ ঘোষণার এখতিয়ার নেই। যুদ্ধ ঘোষণার অধিকার রাষ্ট্রশক্তি বা সরকারের। মক্কায় রসুলুল্লাহ সা. ও তাঁর সাহাবিদের নির্যাতিত জীবনের অবসান ঘটে মদিনায় হিজরতের পর। সে-সময়ে রসুলুল্লাহ সা. মদিনায় একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন এবং তাঁর জীবনে যত যুদ্ধ-বিগ্রহ সবই মদিনা জীবনে। অবশ্য ব্যতিক্রমও রয়েছে।

আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার লক্ষ্যেই রসুলুল্লাহ সা.-এর সকল কর্মতৎপরতা আবর্তিত হয় এবং এই একটি কারণেই তাঁর সাথে সকল কুফুরি শক্তির বিরোধ। কেউ যদি মুহাম্মদ সা.-এর যথার্থই অনুসারী হতে চায় তাহলে তাকেও এই কাজ আঞ্জাম দিতে হবে। অর্থাৎ মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকবে এবং ইসলামের আলোকে চারিত্রিক সংশোধন অর্থাৎ নেক আমলে ভূষিত হতে হবে। একজন ব্যক্তির আখেরাতে সাফল্যের প্রথম ও প্রধান বিষয় হলো আল্লাহর ওপর শিরকমুক্ত ইমান। যে লোক আল্লাহর ওপর ইমান পোষণ করে ও ইসলামকে জীবনাদর্শ হিসেবে বিশ্বাস করে সে কখনো অন্য কোনো জীবনাদর্শের অধীন সন্তুষ্ট জীবন যাপন করতে পারে না। আমলের দুর্বলতা ক্ষমার যোগ্য কিন্তু ইমানের দুর্বলতা ক্ষমার যোগ্য নয়। নামাজ-রোজায় আন্তরিক হওয়ার পরও কোনো লোক যদি তাগুতের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন না করে তাহলে তার আমল একেবারে অসার ও মূল্যহীন। যেমন, আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই-এর দাঁড়ি-টুপি, নামাজ-রোজা সবই ছিল কিন্তু এই খবিস ইসলামের বিজয় না চেয়ে এর ধ্বংস কামনা করেছে এবং তার সকল সম্পর্ক ছিল ইসলামের শত্রুদের সাথে; তাই সে চিহ্নিত হয়েছে মুনাফিক সরদার হিসেবে। পক্ষান্তরে সেই বেদুইনের ইমানে কোনো খাদ ছিল না। রসুলুল্লাহ সা.-এর কাছে ইসলাম কী জানতে চাইলে নামাজ-রোজার সাথে সামর্থ্য হলে জাকাত ও হজের কথা শুনে বলে আল্লাহর কসম, আমি এর বেশিও করবো না আবার কমও করবো না। চলে যাওয়ার পর রসুলুল্লাহ সা. বলেন, তোমরা যদি জান্নাতি দেখতে চাও তাহলে এই লোকটিকে দেখ।

দেশে দেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ইমানদার জনগোষ্ঠী এগিয়ে আসছে- সম্প্রতি আফগান জনগণ বিশ্বের পরাশক্তি আমেরিকা ও তার মিত্রদের হটিয়ে ইসলামের অনুকূলে আফগানিস্তানকে মুক্ত করেছে। এটি আল্লাহপাকের নিদর্শন ছাড়া আর কিছু নয়। আমেরিকা ও ন্যাটো বাহিনী তাদের পুতুল সরকারকে টিকিয়ে রাখতে পারেনি। বিপুল সামরিক সরঞ্জাম ও সেনাবাহিনী কোনো কাজেই আসেনি। একটি গুলি ছোঁড়ারও সাহস হয়নি। এক রক্তপাতহীন বিপ্লব। আল্লাহপাকের নিদর্শন বৈ আর কিছু নয়। এর আর কোনো ভিন্ন ব্যাখ্যা নেই। আল্লাহপাক জমিনে ইমানদারদের প্রতিষ্ঠিত করবেন। এটি তাঁরই ওয়াদার বাস্তবায়ন। আফগানরা নবি মুহাম্মদ সা.-কে নিজেদের আদর্শ মেনে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছে, যেটি সত্যই প্রশংসনীয়। এই উদার ও ক্ষমাশীল আচরণ তাদের প্রতিষ্ঠা লাভে সহায়ক হবে বলে মনে করি। সত্যই মুহাম্মদ সা. সব সময়ের জন্যই আদর্শ। কী শান্তি, কী যুদ্ধ সকল পরিস্থিতিতে তিনিই আমাদের আদর্শ। আল্লাহপাক সকল অবস্থায় তাঁকে আদর্শ হিসেবে মেনে চলার তৌফিক মুসলিম উম্মাহকে দান করুন। আমিন।

 

Comments