বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম
‘মুমিনরা তো পরস্পর ভাই ভাই, অতএব (বিরোধ দেখা দিলে) তোমাদের ভাইদের মাঝে মীমাংসা করে দাও, আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করো, আশা করা যায় তোমাদের ওপর দয়া করা হবে’- সুরা হুজুরাত ১০।
নামকরণ : সুরার ৪ নং আয়াতের হুজরা (গৃহ) শব্দটিকে নাম হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে।
নাজিলের সময়কাল : রসুলুল্লাহ সা.-এর নবুয়তের শেষের দিকে এই সুরার আয়াতসমূহ একই সাথে অবতীর্ণ না হয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে নাজিল হয়েছে। বিষয়বস্তুর সামঞ্জ্যের কারণে বিচ্ছিন্ন আয়াতসমূহ এই সুরায় একত্রে সন্নিবেশিত করা হয়েছে। যেমন, ৪ নং আয়াতে যেটা বলা হয়েছে সেটি নবম হিজরিতে বনি তামীম গোত্র সম্পর্কে নাজিল হয়েছিল। তারা রসুলুল্লাহ সা.-এর সাথে সাক্ষাত উদ্দেশ্যে এসে অপেক্ষা না করে নবি সা.-এর স্ত্রীদের হুজরা বা গৃহের বাইরে থেকে ডাকাডাকি শুরু করেছিল। ৬ নং আয়াত সম্পর্কে বলা হয়েছে ওয়ালিদ ইবনে উকবা সম্পর্কে নাজিল হয়েছে। সদ্য ইসলাম গ্রহণকারী বনি মুস্তালিক গোত্র থেকে জাকাত আদায় করতে তাকে রসুল সা. পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো কারণে তিনি ভয় পেয়ে সেখানে না গিয়ে মদিনায় ফিরে এসে বলেন, তারা জাকাত দিতে অস্বীকার করেছে ও তাকে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছে। ওয়ালিদ ইবনে উকবা মক্কা বিজয়ের পরে ইসলাম গ্রহণ করেন।
বিষয়বস্তু : এই সুরায় মুসলমানদেরকে এমন আদব-কায়দা, আচার-আচরণ, শিষ্টাচার শিক্ষা দেয়া হয়েছে যা তাদের ইমানদারসূলভ স্বভাব-চরিত্র ও ভাবমূর্তির সহায়ক। প্রথম পাঁচ আয়াতে আল্লাহ ও তাঁর রসুল সা.-এর ব্যাপারে আদব-কায়দা ও শিষ্টাচার উল্লেখ করা হয়েছে। এরপর নির্দেশ দেয়া হয়েছে প্রতিটি খবর বিশ্বাস না করে সেটি যাচাই-বাছাই করে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য। মুসলমানদের দুটি দল সংঘর্ষে লিপ্ত হলে কর্মনীতি উল্লেখ করা হয়েছে এবং মুসলমানদের সম্পর্ক পরস্পর ভাই ভাই ও তাদের মাঝে বিরোধ মীমাংসা করে দেয়ার কথা বলা হয়েছে।
নৈতিক চরিত্রের মারাত্মক কিছু ত্রুটি থেকে আত্মরক্ষার কথা বলা হয়েছে এবং নাম উল্লেখ করে সেগুলি হারাম করা হয়েছে। একে অপরকে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা, বদনাম ও উপহাস করা, খারাপ নামে ডাকা, খারাপ ধারণা পোষণ করা, অন্যের গোপনীয় বিষয় খোঁজাখুঁজি করা, গিবত করা ইত্যাদি। এরপর গোত্রীয় ও বংশীয় আভিজাত্যের মূলে আঘাত হেনে বলা হয়েছে সমস্ত মানুষ এক মূল উৎস থেকে সৃষ্টি হয়েছে। জাতি ও গোত্রে বিভক্ত হওয়া পরিচিতির জন্য। সবশেষে বলা হয়েছে, মৌখিক ইমান বড় কথা নয় বরং আল্লাহ ও তাঁর রসুল সা.-কে মানা ও আনুগত্য করা এবং আল্লাহর পথে জানমাল কুরবানি করাই ইমানের দাবী।
ব্যাখ্যা : ১০ নং আয়াতটি বিশ্ব মুসলিম ভ্রাতৃত্বই প্রকাশ পেয়েছে। ভ্রাতৃত্বের দাবী হলো পরস্পর কল্যাণ কামনা। এপ্রসঙ্গে রসুলুল্লাহ সা.-এর অনেক উক্তি রয়েছে।
হজরত জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ রা. বলেন, ‘রসুলুল্লাহ সা. আমার থেকে তিনটি বিষয়ে বাইয়াত নিয়েছেন। এক. নামাজ কায়েম করবো। দুই. জাকাত আদায় করবো। তিন. মুসলমানদের কল্যাণ কামনা করবো’- বুখারি।
হজরত আবু হুরাইরা রা. বর্ণনা করেছেন, ‘রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন : প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অপর মুসলমানের জান, মাল ও ইজ্জত হারাম’- মুসলিম।
হজরত আবু সাঈদ খুদরি রা. ও হজরত আবু হুরায়রা রা. বলেন, ‘রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন : এক মুসলমান আরেক মুসলমানের ভাই। সে তার ওপর জুলুম করে না, তাকে সহযোগিতা করা পরিত্যাগ করে না এবং তাকে লাঞ্ছিত ও হেয় করে না। কোনো ব্যক্তির জন্য তার কোনো মুসলমান ভাইকে হেয় ও ক্ষুদ্র জ্ঞান করার মতো অপকর্ম আর নেই’- মুসনাদে আহমাদ।
হজরত সাহল ইবনে সা’দ সায়েদী নবি সা.-এর এই হাদিস বর্ণনা করেছেন, ‘ইমানদারদের সাথে একজন ইমানদারের সম্পর্ক ঠিক তেমন যেমন দেহের সাথে মাথার সম্পর্ক। সে ইমানদারদের প্রতিটি দুঃখ-কষ্ট ঠিক অনুভব করে যেমন মাথা দেহের প্রতিটি অংশের ব্যথা অনুভব করে’- মুসনাদে আহমাদ।
অনুরূপ একটি হাদিসে রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন : ‘পারস্পরিক ভালোবাসা, সুসম্পর্ক এবং একে অপরের দয়ামায়া ও স্নেহের ব্যাপারে মুমিনগণ একটি দেহের মতো। দেহের যে অংশেই কষ্ট হোক না কেন তাতে গোটা দেহ জ্বর ও অনিদ্রায় ভুগতে থাকে’- বুখারি ও মুসলিম।
আর একটি হাদিসে নবি মুহাম্মদ সা. বলেছেন : মুমিনগণ পরস্পরের জন্য একই প্রাচীরের ইটের মতো, একে অপরের থেকে শক্তি লাভ করে থাকে’- বুখারি ও তিরমিযী। মুমিনদের পরস্পর সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার জন্য যত কারণ রয়েছে পরবর্তী আয়াতসমূহে আল্লাহপাক সবই হারাম করেছেন।
আয়াতের দ্বিতীয় অংশে বিরোধ দেখা দিলে মীমাংসা করে দেয়া ও এব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং বলা হয়েছে বিনিময়ে দয়া করা হবে। বিবাদ মীমাংসা করা প্রসঙ্গে রসুলুল্লাহ সা.-এর অনেক উক্তি রয়েছে।
আনাস রা. থেকে বর্ণিত, ‘রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, আমি কি তোমাকে একটি ব্যবসায়ের কথা বলে দিব না? সে বললো, অবশ্যই ইয়া রসুলুল্লাহ। তিনি বললেন, যখন লোকেরা ঝগড়া-ফাসাদ করে তখন তাদের মধ্যে সন্ধি করে দাও, আর যখন তারা দূরত্ব সৃষ্টি করে তখন তাদেরকে নিকটবর্তী করে দাও’- মুসনাদে বাজ্জার।
আবু দারদা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, আমি কি তোমাদেরকে এমন বিষয়ের খবর দেব না, যা মর্যাদার দিক থেকে নামাজ, রোজা এবং সদকার চেয়েও উত্তম? সাহাবিগণ বললেন, অবশ্যই ইয়া রসুলুল্লাহ সা.। তিনি বললেন, তা হলো পরস্পরের সম্পর্ক ঠিক করে দেয়া আর পরস্পরের মধ্যে খারাপ সম্পর্ক ধ্বংস করা’- আবু দাউদ।
ইবনে শিহাব রহ. থেকে বর্ণিত, হুমাইদ ইবনে আব্দুর রহমান রহ. তাকে অবহিত করেছেন যে, তার মা উম্মু কুলছুম বিনতে উকবা রা. তাকে অবহিত করেছেন, তিনি রসুলুল্লাহ সা.-কে বলতে শুনেছেন, সে ব্যক্তি মিথ্যুক নয়, যে ব্যক্তি লোকদের মধ্যে সন্ধি স্থাপনের লক্ষ্যে কোনো ভালো বিষয় উপস্থাপন করে বা ভালো কথা বলে’- বুখারি।
সবই ইতিবাচক কথা। এর বিপরীতে যারা ভাইয়ে-ভাইয়ে, স্বামী-স্ত্রী, পিতা-পুত্র বা বিভিন্ন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মাঝে বিবাদ বাধিয়ে দেয় বা কোনো সেটেল্ড বিয়ে ভেঙ্গে দিয়ে যুবক-যুবতিদের স্বপ্ন ভঙ্গ করে তাদের গুনাহের মাত্রা কতখানি। কেবল হিংসুটে ব্যক্তিই এমন ধরনের নিকৃষ্টতম কাজ করতে পারে, ওরা সব জাহান্নামের কীট। এই আচরণের কারণে তারা একেবারেই আমলশূন্য হয়ে পড়ে। তওবার মাধ্যমেই কেবল মুক্তি সম্ভব।
রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, আগুন যেমন শুকনা কাঠকে জ্বালিয়ে ভস্ম করে দেয় তেমনি হিংসা মানুষের নেক আমল ধ্বংস করে দেয়। আল্লাহপাক মানুষের মাঝে সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য বলেছেন এবং এ ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করতে বলেছেন। সেখানে সম্পর্ক বিনষ্টকারীর মুসলমান থাকার কোনো অধিকার নেই, ওরা সব জালেম। প্রায়শ্চিত্ত হতে পারে কেবল আল্লাহর কাছে তওবা ও ক্ষতিগ্রস্তদের কাছ থেকে ক্ষমা চাওয়ার মাধ্যমে। ক্ষতিগ্রস্তরা মনের ঔদার্য দিয়ে ক্ষমা করলে আল্লাহপাক তার বিনিময়ে মজলুমকে ক্ষমা করে দিবেন।
তওবা করার মাধ্যমে আল্লাহপাক বদ আমলকে নেক আমলে পরিবর্তিত করে দেন তখনই যখন সে বারবার অনুতপ্ত হয় ও ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য দোওয়া করতে থাকে।
সুরা হুজুরাতে মুসলমানদেরকে আদব-কায়দা ও শিষ্টাচার শিক্ষা দেয়া হয়েছে। দুর্ভাগ্য, মুসলমানরা সদাচরণ ও সুন্দর আদব-কায়দা প্রদর্শন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এগুলি সবই মানবীয় গুণাবলী। এসব গুণাবলীতে যারা সমৃদ্ধ তারাই দুনিয়া ও আখেরাতে সফলকাম। আল্লাহপাক আমাদেরকে তাঁর বান্দাদের সাথে সদাচরণ এবং সবার মান-ইজ্জত-সম্মান ও জান-মালের নিরাপত্তা বিধানের তৌফিক দান করুন। আমিন। ২৬.১০.২০২১
Comments
Post a Comment