দেশের রপ্তানি আয়ের অন্যতম খাত চামড়া। শিল্প হিসেবে চামড়া আমাদের দেশে
এখনো তেমন বিকশিত হতে পারেনি। মূলত কাঁচা চামড়া ও কিছুটা প্রক্রিয়াজাত করে রপ্তানী
করা হয়। এই চামড়া বৈদেশিক আয়ের অন্যতম উৎস হওয়ার সাথে সাথে দেশের হত-দরিদ্র ও দ্বীনি
প্রতিষ্ঠান মাদ্রাসা-ইয়াতিমখানার আয়েরও প্রধানতম উৎস। সারা বছর সংগৃহিত চামড়ার মধ্যে
কেবল কোরবানীর ঈদেই আসে প্রায় ৪৫% । ২০১৩ সালে গরুর চামড়ার সংগ্রহ মূল্য ছিল প্রতি
বর্গফুট ৮০-৯০ টাকা এবং ২০১৪ সালেও প্রায় এমনই। কিন্তু এ বছরে ছিল মাত্র ৫০-৫৫ টাকা।
এই ন্যূনতম মূল্যও এবারের কোরবানীর ঈদে পাওয়া যায়নি। গরুর চামড়া ৬/৭ শত টাকা বা কম-বেশি
ও ছাগলের চামড়া মাত্র ৪০/৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। সিন্ডিকেট করে যে যেভাবে পেরেছে সেভাবে
চামড়া কিনেছে। কম মূল্যের পেছনে নানা যুক্তি দেখানো হচ্ছে। বিশেষ করে ট্যানারি শিল্প
স্থানান্তর। বর্ডারে চোরাচালান বন্ধ করে দিয়ে পানির দরে চামড়া কিনে একটি গোষ্ঠী দরিদ্রদের
পাওনা লুটে নিলো। ভারত থেকে গরু আসতে পারে, পেঁয়াজ-রসুন আসতে পারে-প্রক্রিয়ার মাধ্যমে
কাঁচা চামড়া ভারতে যেতে সমস্যা কোথায়? সেখানে সরকারের তো আয়ও হতে পারে।
আমাদের দেশে সেবাখাত প্রায় পুরোটাই দুর্নীতিগ্রস্ত। ঘুষ এখন ইনসেন্টিভ।
ঘুষ ছাড়া অফিস-আদালতে কাজ হয় না। পিয়ন-চাপরাশি থেকে শুরু করে সব ধরনের নিয়োগে বাণিজ্য।
মেধা-যোগ্যতার কোন মূল্যায়ন নেই। শুধু সরকারি খাতই নয়। যে যেখানে সুযোগ পাচ্ছে হাতিয়ে
নিচ্ছে। নীতি-নৈতিকতা ও পরকালের ভয় সবই মূল্যহীন হয়ে পড়েছে। কয়েক দিন আগে পাসপোর্ট
অফিসে গিয়েছিলাম। লাইনে দাঁড়িয়ে আছি এমন সময় আমার স্ত্রী এসে বললো, আমাদের ফরমের উল্টোপিঠে
অফিসে ব্যবহারের জন্য একটি ফরমের ফটোকপি লাগবে। লাইনের পেছনের জনকে বলে ফটোকপির দোকানে
গেলাম। প্রতি কপি ২০/-টাকা (যেটা সর্বোচচ ২/-টাকা হতে পারে)। প্রশ্ন করলে জানালো আপনি
রিক্সা ভাড়া দিয়ে অন্যখান থেকে করিয়ে আনেন। কত সহজ যুক্তি। কেউ দেখার নেই। তার কোন
কাগজ ব্যবহার ছাড়াই দুই কপি ফটোস্ট্যাটের জন্য ৩০/-টাকা দিতে হলো। সিএনজিতে গেলে তারা
মিটারে যাবে না। একটু সমস্যায় পড়েছেন বুঝতে পারলে রিক্সাওয়ালা ৫০ টাকার স্থলে ১০০টাকা
দাবী করবে। মন্ত্রী-মিনিস্টার-বড় বড় আমলা থেকে শুরু করে একজন সাধারণ মানুষও সুযোগ পেলে
হাতিয়ে নিচ্ছে। ২/১ জন ব্যতিক্রম। জাতিগতভাবে আমাদের চরিত্রই আজ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে।
ভাবখানা এমন, অন্যরা হাতিয়ে নিচ্ছে আমি কেন পেছনে পড়ে থাকবো? বেশি বেশি পাওয়ার এক দুর্বার
আকাঙ্খা সবার মধ্যে পেয়ে বসেছে। এ যেন সূরা আত তাকাসুরে বর্ণিত চরিত্রেরই পরিচায়ক।
দেশের স্বাস্থ্য ও শিক্ষা প্রায় পুরোটাই সেবা থেকে বাণিজ্যিক হয়ে পড়েছে।
এক সময় দেশের শিল্পপতিরা শিল্প-কারখানা গড়ে তোলার মাধ্যমে নিজেদের আয় উপার্জনের পাশাপাশি
কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতেন এবং সেবার লক্ষ্যে গড়ে তুলতেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হাসপাতাল।
আদমজী জুটমিলে সরাসরি ৩৬ হাজার লোকের কর্মসংস্থান ছিল। রাস্তায় চলতে আদমজী বয়েজ স্কুল,
আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ এখনো চোখে পড়ে। ফার্মগেটে ইস্পাহানী চক্ষু হাসপাতাল সেবার
এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। আমাদের কুষ্টিয়ায় মোহিনী মিল দেশের অন্যতম শিল্পপ্রতিষ্ঠান
ছিল। পাশাপাশি তারা বিশাল খেলার মাঠ, মোহিনীমোহন বিদ্যাপীঠ ও হাসপাতাল গড়েছিল স্রেফ
সেবার লক্ষ্যে। এখন আমাদের দেশের শিল্পপতিরা শিল্পকারখানার পরিবর্তে ঝুঁকে পড়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
ও হাসপাতাল গড়ে তুলতে। এটাকেই ভাবছে সবচেয়ে নিরাপদ ব্যবসা। ভারতের টাটা-বিড়লারা ব্যবসায়ের
পাশাপাশি সেবার লক্ষ্যে গড়েছে হাসপাতাল। তাই দেখা যায় আমাদের দেশের বিপুল পরিমাণ মানুষ
চিকিৎসার জন্য ভারতে ছুটছে। সেখানে চিকিৎসা ব্যয় যেমন স্বল্প, তেমনি সেবার মানও অনেক
উন্নত। আমাদের এখানে ডাক্তারদের ফির পাশাপাশি কমিশন বাণিজ্য বড় রমরমা। এই অনৈতিক কমিশন
বাণিজ্যের কারণেই অধিকাংশ ডাক্তাররা অপ্রয়োজনীয় টেস্ট দিয়ে থাকে। ডাক্তার পরিবর্তন
করলে রোগীকে আবার নতুন করে টেস্টের মুখোমুখি হতে হয়।
এবারের ঈদে রাস্তাঘাটের বেহাল দশা খুব লক্ষ্য করেছি। এ করুণ অবস্থা সর্বত্র।
নিজ বাড়ি থেকে ভেড়ামারা এবং সেখান থেকে কুষ্টিয়া যাতায়াতে কী যে বিড়ম্বনা! রাস্তা তৈরীসহ
সকল উন্নয়ন কর্মকান্ডে সীমাহীন দুর্নীতিই এমন অবস্থার জন্য দায়ী। পরিত্রাণের উপায় কী?
আমার মনে হয় কারোরই জানা নেই। দেশে ঘুষ-দুর্নীতি, গুম-খুন, নগ্নতা-বেয়াহাপনা, আমানত
ও ওয়াদা-প্রতিশ্রুতি রক্ষার বেহাল দশা দেখে মনে হয় আমরা বিশ্বাসবিবর্জিত হয়ে পড়েছি।
অর্থাৎ আমরা আর আল্লাহ, পরকাল, বেহেশ্ত-দোযখ বিশ্বাস করিনা। কিন্তু তাই বা কী করে বলি? মসজিদগুলো চাকচিক্যময় হয়ে উঠছে, জুমার দিনে উপচেপড়া
মুছল্লি (চলাচলের রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে), মসজিদের দানবাক্সে আদায়ও কম নয় (কোন
কোন মসজিদে জুমার দানবাক্সে একদিনে লক্ষাধিক টাকা আদায় হয়), এত এত কোরবানীর পশু জবেহ
হচ্ছে, হজ্বযাত্রীর সংখ্যাও কম নয়, আবার মসজিদগুলোয় জান্নাতপ্রাপ্তির বয়ানও সমানে চলছে।
তারপরও কী করে বলি যে আমরা বিশ্বাসবিবর্জিত? আসলেই কী সব লোক দেখানো, অন্তসারশূন্য?
কিছুটা বোঝা যায় ফজরের জামাতে মসজিদে গেলে। জুমার দিনের উপস্থিতির তুলনায় ৫% মুছল্লিও
ফজরে পাওয়া যায় না। রাসূল (সা)-এর উক্তি বড় ভয়ের-‘আমাদের ও মুনাফিকদের
মধ্যে পার্থক্য হলো ফজর ও এশার ছালাতে হাজির হওয়া’। আমি আর এর
ব্যাখ্যা করতে রাজি নই। হালাল উপার্জন ইবাদতের পূর্বশর্ত। অবৈধ উপার্জনে গঠিত রক্ত-মাংস
জাহান্নামের জ্বালানী বৈ আর কিছু নয়। এত কদর্য চরিত্র নিয়ে এই নামায, রোযা, হজ্ব, কুরবানী,
দান কোন কিছুই কবুল হওয়ার মত নয়। একদিন মসজিদে নববীতে আলু-থালু বেশে এক লোক আল্লাহর
কাছে কাতরভাবে প্রার্থনা করছিলো। রাসূল (সা) তাকে দেখে বললেন, ‘তার প্রার্থনা কবুল হবে কী করে ও যা খায় তা হারাম, যা পরিধান করে তাও
হারাম’। বর্তমান মুসলমানদের অবস্থাও তাই দাঁড়িয়েছে। চরিত্রের দিক দিয়ে মনে
হয় আমরাই সবচেয়ে অধপতিত।
আমার দৃষ্টিতে আমাদের আর একটি বড় সমস্যা রাজনীতি। রাজনীতিতে সুস্থধারা
ও নীতি-নৈতিকতা থাকলে দেশের জনগণ স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভালো হয়ে যেতে পারতো। ইউরোপ-আমেরিকা
ও প্রতিবেশী ভারত যে রাজনীতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে তাতে তাদের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ
সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হচ্ছে। যশোর বোর্ডের প্রাক্তন চেয়ারম্যান সাহেব একদিন আমাদের স্কুলে
এসেছিলেন। তিনি বললেন চেয়ারম্যান সাহেব সৎ হলে ৮০% কর্মকর্ত-কর্মচারী সৎ হয়ে পড়ে এবং
২০% লোক সামান্য মটিভিশনেই ঠিক হয়ে যায়। আর বাকিদের জন্য আইনের শাসন ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা
গ্রহণ করতে হয়। রাষ্ট্রীয় ব্যাপারটিও তাই। সরকারের মধ্যে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা থাকলে
সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অপরাধ করার ক্ষেত্রে হিসেব করতো এবং জনগণের মাঝে তার প্রতিফলন
ঘটতো। সম্ভবত হযরত ওমর (রা)-এর উক্তি, ‘জনগণ শাসকদেরই
অনুসরণ করে (ভুল হলে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি)।’ রাজনীতিতে
প্রকাশ্য বিভাজন আজ আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগকে মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্থ করছে।
এনবিআর, দুদককে বিরোধী দল দমনে ব্যবহার করায় তাদের মাঝে বড় বড় ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যক্তরা
দেশে বিনিয়োগ না করে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। আবার সরকারের সাথে যারা সংশ্লিষ্ট তারা
ভাবে সরকারের পরিবর্তন হলে তারা সমস্যায় পড়বেন, ফলে তারাও দেশে বড় বড় বিনিয়োগে উৎসাহ
হারাচ্ছে। আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশে যেখানে বিদেশী বিনিয়োগ দরকার সেখানে দেশীয় বিনিয়োগকারীদের
বিনিয়োগে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা সত্যিই বিপদজনক। পত্র-পত্রিকায় প্রায়ই বিদেশে অর্থপাচারের
খবর দেখা যায়। রাজনীতিতে পরস্পর আস্থা ও বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে না পারলে দেশে টেকসই উন্নয়ন
কখনই সম্ভব নয়। বিরোধী দলকে ত্রাণপ্রদানে বাধাদান এবং এক এক জনের বিরুদ্ধে ৬০/৭০টি
মামলা শুনলে বিদেশীরাই বা আমাদেরকে কিভাবে মূল্যায়ন করবে? এব্যাপারে সরকারকেই এগিয়ে
আসতে হবে এবং সমঝোতার মধ্য দিয়ে দেশে গণতান্ত্রিক ও সুস্থধারার রাজনীতি চর্চা শুরু
করতে হবে যাতে আগামীতে সবার জন্য একটি নিরাপদ বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব হয়। ১৪/০৯/২০১৭
Comments
Post a Comment