Skip to main content

জুমু’আতুল বিদা (কুচিয়ামোড়া বাজার জামে মসজিদে প্রদত্ত বক্তব্য) ২৩/০৬/২০১৭


বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম।

মাসের মধ্যে সেরা মাস রমযান এবং দিনের মাঝে সেরা হলো জুমুআবার (শুক্রবার)। রমযান মাস আমাদের মাঝ থেকে বিদায় নিতে যাচ্ছে এবং আজকে শেষ জুমুআ (জুমুআতুল বিদা)। জুমুআর দিনে মসজিদে আসার ক্ষেত্রে আমাদের বেশ প্রস্তুতি থাকার দরকার। এ দিনে গোসল করাটাকে ওয়াজিব (বুখারি শরীফ-৮২৮ নং হাদিস)বলা হলেও অধিকাংশের মতে সুন্নাত। পবিত্র-পরিচ্ছন্ন হয়ে উত্তম পোশাকে সজ্জিত হয়ে সকাল সকাল মসজিদে উপস্থিত হওয়া সবার জন্য অত্যাবশ্যক। আসার ক্ষেত্রে যারা আগে আসবে পর্যাক্রমে উট, গরু, ছাগল, মুরগি ও ডিম কুরবানির ছাওয়াব ফেরেশÍারা তাদের আমলনামায় লিখতে থাকে এবং খতিব সাহেব যখন মিম্বরে আরোহণ করেন তখন ফেরেশ্তারা লেখা বন্ধ করে খুতবা শুনতে থাকেন। আগে আসার সাথে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় এভাবে কাতারে কোন ফাঁক রেখে বসে পড়তে হবে। যারা কাতারের প্রথম দিকে বসে তাদের জন্য ফেরেশ্তারা মাগফেরাতের দোয়া চাইতে থাকে। কাতারের মাঝে ফাঁক থাকলে পেছনে আসা মুসুল্লী ডিঙ্গায়ে ডিঙ্গায়ে আসতে চায় যা খুবই অপছন্দনীয় ও গুনাহের কাজ।

রাসূল (সা) তাঁর হায়াত বৃদ্ধির জন্য আল্লাহর কাছে কখনই আবেদন করতেন না; কিন্তু রজব মাস এলে তিনি আল্লাহর কাছে রজব ও শাবান মাসের বরকত ও রমযান মাস পর্যন্ত তাঁকে পৌঁছে দেয়ার জন্য আল্লাহর কাছে নিবেদন করতেন। তিনি রমযান মাসের শেষ দশকে আঁটসাট বেঁধে মসজিদে ইতিকাফে বসে পড়তেন। কত ব্যস্ত মানুষ তিনি-একাধারে রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান, প্রধান বিচারপতি, সেনানায়ক, তিনিই সব, আবার সব ধরনের গুনাহ ও ত্রুটিমুক্ত- সেই তিনিই সবকিছু থেকে নিজেকে মুক্ত করে একান্তভাবে তাঁর রবের ইবাদত-বন্দেগীর কঠোর শ্রমে নিজেকে নিয়োজিত করতেন। একবার ইতেকাফ করতে না পারায় পরের বছর তিনি বিশ দিন ইতিকাফে কাটান। এই রমযান মাসেরই একটি রাত, যে রাতে কুরআন নাজিল হয়েছে-যা হাজার মাস অপেক্ষাও উত্তম তা পাওয়া যাবে রমযানের শেষ দশকের বেজোড় রাতে। তাই যারা শেষ দশকে ইতিকাফে বসেন তাদের নছিবে লাইলাতুল কদর পাওয়া খুবই স্বাভাবিক। কারণ তাদের পুরো সময়টাই ইবাদত হিসেবে গণ্য হয়। আল্লাহপাক তাঁর বান্দাদের ক্ষমা করতে চান, শাস্তি দেয়া তাঁর অভিপ্রায় নয়। এই রমযান মাস ও লাইলাতুল ক্বদর ক্ষমাপ্রাপ্তির এক অপূর্ব সুযোগ। হাদিসের ভাষাও তাই বলে-যারা ঈমান ও এহতেছাবের সাথে রমযানে সিয়াম পালন করবে, আল্লাহ তার পেছনের সব গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন। লাইলাতুল ক্বদর সম্পর্কেও একই কথা বলা হয়েছে-এ রাতে ছাওয়াবে আসায় যারা দন্ডায়মান হবে, আল্লাহ তার পেছনের সব গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন। শুধু দরকার শিরকমুক্ত নির্ভেজাল ঈমান ও আল্লাহর কাছে ফিরে (তাওবা) আসার দৃঢ় প্রত্যয়। বান্দা যখন তাওবা করে তখন আর সে অতীতের গুনাহের জন্য শাস্তিযোগ্য থাকে না। এই যে রমযান, টানা একটি মাস আল্লাহর সাময়িক নিষেধাজ্ঞার কারণে হালাল জিনিস ভোগ-ব্যবহার থেকে আমরা বিরত থাকলাম, কেন থাকলাম এ প্রশ্নের জবাবে সবাই বলবেন যে, আল্লাহর ভয়ে; কারণ কেউ না দেখলেও আল্লাহ দেখছেন-সিয়াম পালনের মাধ্যমে এই উপলব্ধিই আমাদের অন্তরে দৃঢ় হয়েছে। হ্যাঁ, আল্লাহ গোপন ও প্রকাশ্য সকল বিষয়ে জ্ঞাত। আল্লাহ সম্পর্কে আমাদের ঈমান যদি এমনই হয়, যা রমযান মাসে আমরা আমাদের আমলে প্রকাশ করি (অর্থাৎ সাময়িক নিষিদ্ধের ফলে হালাল জিনিস ত্যাগ করি) তাহলে আল্লাহর স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ কাজের সাথে আমাদের কি কোন সম্পর্ক থাকতে পারে? আল্লাহর প্রতি ঈমান ও দুষ্কর্ম পরস্পর বিপরিতমুখি। কারো মধ্যে আল্লাহর প্রতি ঈমান ও ভয় যদি থাকে, তাহলে অবশ্যম্ভাবী সে দুষ্কর্ম মুক্ত হবে।

আমি আপনাদেরকে ছদকাতুল ফিতর সম্পর্কে অবহিত করতে চাই। ছদকাতুল ফিতর রোযার দোষ-ত্রুটি দূর ও আল্লাহর গরীব বান্দাদেরকে ঈদের আনন্দে শরীক করানোর জন্য একটি ওয়াজিব ইবাদত। রাসূল (সা) ও চার খলিফার যুগে জনপ্রতি তৎকালিন খাদ্যশষ্য এক ছা পরিমাণ খেজুর/গম/যব/কিসমিস/পনির যে কোন একটি দিয়ে আদায় করা হত। হযরত আমীর মুয়াবিয়া (রা)-এর যুগে গমের দাম বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে তিনি বলেন, কেউ ছদকাতুল ফিতর গমের মাধ্যমে দিতে চাইলে অর্দ্ধ ছা দিতে পারবে। বিরোধীতা থাকলেও সে সময়ে অনেকে তা মেনে নেন এবং এটাও একটি মত হিসেবে গৃহিত হয়। ইসলামিক ফাউন্ডেশন সর্বনিম্ন অর্দ্ধ ছা গমের দাম ৬৫/- টাকা নির্ধারণ করলেও আবার প্রায় দুই হাজার টাকা পর্যন্ত বিভিন্ন বিকল্পের কথা বলেছেন। আমি আপনাদেরকে অনুরোধ করছি যাদের পক্ষে সম্ভব এক ছা পরিমাণ গমের দাম ১৩০/- হিসেবে প্রদানের জন্য। কারণ আমাদের দেশে খাদ্যশষ্যের মধ্যে গমের দামই সর্বনিম্ন।

আমি এখন যাকাত প্রদানের বিষয়ে আপনাদেরকে বলবো। নামাযের পরে যাকাত ইসলামের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ এবং একটি আর্থিক ইবাদত। মুসলমান হওয়ার জন্য নামাযের সাথে যাকাতও অপরিহার্য-যদি তারা তাওবা করে এবং নামায কায়েম করে ও যাকাত আদায় করে তাহলে তারা তোমাদের দ্বীনি ভাই। যাকাত আদায় না করা মূলত মুশরিকদের কাজ-ধ্বংস ঐ সব মুশরিকদের জন্য যারা যাকাত আদায় করে না। ইসলামে নামায ও যাকাতের মধ্যে কোন পার্থক্য করার সুযোগ নেই। হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা) বলেছেন-নামায ও যাকাত একটি অপরটির সম্পূরক, একটি ছাড়া অন্যটি কবুল হয় না। রাসূল (সা)-এর ইন্তেকালের পরে কিছু লোক যাকাত দিতে অস্বীকার করলে আবু বকর (রা) অস্বীকারকারীদেরকে মুরতাদ (ধর্মত্যাগী) ঘোষণা করে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। সমাজে নামায কায়েম ও যাকাত আদায় রাষ্ট্রসরকারের দায়িত্ব হলেও মুসলমানরা স্ব-উদ্যোগে মসজিদ নির্মাণ করে নামাযের ব্যবস্থা করলেও যাকাত আদায়ের তেমন সামষ্টিক উদ্যোগ নেই। মানুষের ধারণা সম্পদ থেকে যাকাত আদায় করলে তার সম্পদ কমে যাবে। অথচ সম্পদের যিনি প্রকৃত মালিক (আমরা যে রিজিক দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করো) সেই মহান আল্লাহ বলেন-আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তোমরা যে যাকাত দাও প্রকৃতপক্ষে এর দ্বারা যাকাত দানকারী তার সম্পদ বর্ধিত করে। সম্পদ বৃদ্ধির লক্ষ্যে মানুষ সুদে অর্থলাগায়। অথচ আল্লাহ বলেন-আল্লাহ সুদকে নিশ্চিহ্ন করে দেন এবং দান-সদকাকে ক্রমবৃদ্ধি দান করেন। আল্লাহর পথে খরচের ব্যাপারে কুরআন ও হাদিসে নানাভাবে তাগিদ দেয়া হয়েছে। আল্লাহর পথে খরচকে তিনি নিজের জন্য ঋণ হিসেবে বিবেচনা করেন এবং বলেন-তোমরা কর্জে হাসানা দাও আল্লাহ বহুগুণ বাড়িয়ে দিবেন। তিনি আরো বলেছেন- তোমরা খরচ করো, নিজ হাতে নিজেকে ধ্বংস করো না। রাসূল (সা) বলেছেন-তোমরা আল্লাহর পথে খরচ করো, কত খরচ করলে তা হিসেব করো না; তাহলে আল্লাহও বেহিসেবী দান করবেন। বৈধ উপায়ে সম্পদ উপার্জনের সাথে হিসেব করে যাকাত আদায়ের মাধ্যমেই কেবল সম্পদ পবিত্র হয়। কুরআনের বাণী-তাদের সম্পদ থেকে সাদাকাহ গ্রহণ করো এবং এর মাধ্যমে তাদেরকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করো। একজন মুসলমান এই বিশ্বাস নিয়েই যাকাত প্রদান করে যে, এর মাধ্যমে তার সম্পদ পবিত্র হবে এবং দুনিয়া ও আখিরাতে সে অনেক গুণ বৃদ্ধিসহ ফেরৎ পাবে। এই বাজারে অধিকাংশ দোকানের মালিকের ওপর যাকাত ফরজ। নগদ টাকা-পয়সার সাথে ব্যবসায় পণ্যের মূল্য হিসেব করে নেছাব পরিমাণ (স্থানীয় বাজারদরে স্বর্ণের হিসেবে ৩.৩ লক্ষ টাকা বা রৌপ্য হিসেবে ৪০ হাজার টাকা) হলে যাকাত প্রদান ফরজ। আমি আপনাদেরকে অনুরোধ করবো হিসেব করে যাকাত আদায়ের জন্য, তা না হলে আপনাদের নামায, হজ¦ কোন কিছুই গৃহিত হবে না এবং আপনাদের মুসলমান হিসেবে পরিচয় দানই মিথ্যা বিবেচিত হবে। আল্লাহপাক আমাদেরকে তাঁর সকল বিধি-বিধান নিষ্ঠার সাথে পালনের তাওফিক দান করুন। (ঈষৎ পরিবর্তিত) ২৭/০৬/২০১৭

Comments