পরিবার, সমাজ
ও রাষ্ট্র সর্বত্রই সমালোচনা, নিন্দাবাদ, একে অপরের ত্রুটিতালাশ, হেয় করা, অপমান করা,
গালি-গালাজ করা এবং মারপিট-গুম-খুন যেন মহামারি আকারে দৃশ্যমান। ফলে পরিবার, সমাজ ও
রাষ্ট্র সবখানে শান্তি-নিরাপত্তা যেন সোনার হরিণ। রাষ্ট্রের শীর্ষস্থান থেকে প্রতিপক্ষকে
নোংরা ভাষায় আক্রমণ এবং বিরোধী দলের পক্ষ থেকেও সমানভাবে আক্রমণ যেন একটি স্বাভাবিক
ব্যাপার হয়ে পড়েছে। ইউরোপ-আমেরিকাসহ বর্তমান বিশ্বে নেতৃত্বের আসনে যারা আসীন তারা
তাদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে ভদ্রতা ও শালীনতার একটি মানদন্ড নিজেরা রচনা করে তা
অনুসরণ করছে। ফলে আমাদের দেশের তুলনায় তারা তাদের দেশে শান্তি-নিরাপত্তা ও মানবাধিকার
অনেকখানি নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু আমরা বড় অসহায়। জনগণের জানমালের নিরাপত্তা
বিধানের জন্য যে রাষ্ট্রের সৃষ্টি, সেই রাষ্ট্রই আজ দেশে দেশে জনগণের নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি হয়ে দেখা
দিয়েছে। আমরা নিজেরাই নিজেদেরকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি। অথচ
আমাদের পরিচয় হলো, আমরা মুসলিম-এক উদার ও মধ্যমপন্থী জাতি। আজ উদারতা আমাদের থেকে হারিয়ে গেছে এবং সকল ক্ষেত্রে
সংকীর্ণতা পেয়ে বসেছে। আমাদেরকেই শেখানো হয়েছে-‘যে তার ভাই-এর অপরাধ ক্ষমা করবে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার অপরাধ ক্ষমা
করবেন’ এবং ‘যে তার ভাই-এর দোষ-ত্রুটি গোপন করবে, কিয়ামতের
দিন আল্লাহ তার দোষ-ত্রুটি গোপন করবেন’। অথচ কী আশ্চর্য, আইয়ামে জাহিলিয়াতের মত (ইসলামপূর্ব যুগ) আমরা যুগ
যুগ ধরে বিরোধ জিইয়ে রেখে পরস্পরে ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিচ্ছি এবং একে অপরের রক্তপিপাসুর
ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছি। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণেরও কোন সম্ভাবনা দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না।
ক্ষমা, সহনশীলতা, উদারতা যাদের চরিত্রবৈশিষ্ট্য হওয়ার কথা, আজ সেখানে তা না হয়ে ভর করেছে হিংসা-বিদ্বেষ ও সংকীর্ণতা।
এরা পরকালের জবাবদিহিতা ভুলে গেছে, এ সমাজে ঘৃণিত এমন কোন কাজ নেই, যা এই মুসলিম নামধারীরা
করেনা। ফলে বিশ্বসমাজে এরা হয়েছে সবচেয়ে নিন্দিত ও উপেক্ষিত। হতাশাও এ জাতিকে পেয়ে
বসেছে এবং ধরে নিয়েছে যে ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় তাদের কপালের লিখন। আবার কেউ কেউ ইমাম মেহদী
(আ)-এর আগমন অপেক্ষায় রয়েছে। মুসলিম সমাজের সবাই কি নৈতিক অধপতনের সাথে সংশ্লিষ্ট?
অনেকে জবাব দেবেন-মোটেই না, মুষ্টিমেয় কিছু লোক এই কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছে এবং ইসলামের
দুশমনরা তাদের মদদ যোগাচ্ছে। সাধারণত সমাজে যারা নেতৃত্ব দেয়, ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায়
হোক সাধারণ মানুষ তাদেরকে অনুসরণ করে। ভালোর দিকে পরিবর্তনের সুযোগ পেলে এই জনগোষ্ঠী
সমর্থন দিতে একটুও কুণ্ঠিত হবে না। এটা আশার একটি বড় দিক। ফলে ভালো কিছু করার যারা
প্রত্যাশী তাদের নেতিবাচক চিন্তা-চেতনা-আচরণ-কর্মকৌশল সবকিছু ছেড়ে সকল ক্ষেত্রে ইতিবাচক
হতে হবে।
সমাজের ক্ষুদ্র
ইউনিট হলো পরিবার এবং এই পরিবার থেকেই গড়ে ওঠে সমাজ ও রাষ্ট্র। ইসলাম পরিবারকে সর্বোচ্চ
গুরুত্ব প্রদান করে। আল্লাহর বাণী-‘তুমি নিজে বাঁচ ও তোমার পরিবারকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও’। রাসূল (সা)-এর ওপর প্রথম ঈমান আনেন তাঁর
প্রিয়তমা স্ত্রী, তাঁর ঘরে পালিত ভাইপো এবং একজন ঘনিষ্ট বন্ধু। রাসূল (সা) বলেছেন-যত
রকমের ব্যয় আছে তার মধ্যে সর্বোত্তম ব্যয় হলো আপন পরিবারের জন্য ব্যয়। তাই পরিবার
থেকে উদাসীন হয়ে সমাজ পরিবর্তনের চিন্তা একেবারে অমূলক। আমাদের একক পরিবার বা যৌথ পরিবারে
সত্যি কি শান্তি রয়েছে? আজ আমাদের পরিবারে পরস্পরের প্রতি সৌহার্দ-সম্প্রীতির পরিবর্তে
রয়েছে বিদ্বেষে পূর্ণ। আজ পিতা-মাতার সাথে সন্তানের এবং স্বামী-স্ত্রী ও অন্যান্য সদস্যের
মাঝে সম্পর্ক অনেকটাই তিক্ততায়ভরা। সেখানে সারাক্ষণ ঝগড়া-ঝাটি, নিন্দাবাদ ও পরস্পরের
সমালোচনা। ফলে ঘর যে আমাদের শান্তির নীড়-তা আর কেউ খুঁজে পায় না। তাই সন্তান ছুটছে
বন্ধু-বান্ধবের কাছে এবং এক সময়ে হয়ে পড়ছে মাদকাসক্ত বা জঙ্গি বা সন্ত্রাসী। অথচ সন্তানই
পিতা-মাতার সবচেয়ে আদরের ধন এবং তাদের কল্যাণে নিজের সবকিছু উজাড় করে দেয়। এক সময় এই
সন্তান বখাটে হয়ে পড়ায় পিতা-মাতার কষ্টের সীমা-পরিসীমা থাকে না এবং বর্তমানে সন্তান
কর্তৃক পিতা-মাতা হত্যার ঘটনাও বিরল নয়। সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার রূঢ় আচরণ এবং তাদেরকে
পর্যাপ্ত সময় না দেয়া ও অতিমাত্রায় সমালোচনা সন্তান বখে যাওয়ার অন্যতম কারণ। পরিবারের
সবাইকে নিয়ে একত্রে খানা খাওয়া, তাদের সাথে গল্প-গুজব করা, বেড়ানো ইত্যাদি কাজের মাধ্যমে
তাদেরকে সাহচর্যদান, নামাযে অভ্যস্ত ও দ্বীনি আচার-আচরণ অনুশীলন সন্তানের চরিত্রগঠনে
সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। কিন্তু আজ অধিকাংশ পরিবারে এ সবের অনুপস্থিতি দেখা যায়।
এ ছাড়া দাম্পত্যকলহ (স্বামী-স্ত্রীর পরস্পরের প্রতি সদাচরণের অভাব) এবং পিতা-মাতার
কারো নৈতিকস্খলনও সন্তানকে বিপথগামী করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। তাই সন্তানের চরিত্রগঠনের
ক্ষেত্রে আমাদেরকে অবশ্যই ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে হবে। একটি শ্লোগান সন্তানের চরিত্রগঠনের
ক্ষেত্রে খুবই উপযোগী-‘সন্তানকে শুধুই হ্যাঁ বলুন’। না, সন্তানকে কখনই ভয় দেখিয়ে, শাসন করে বা ধমক দিয়ে (চড়-থাপ্পড় তো
নয়ই) কোন কিছু করানো যাবে না। শুধুই আদর করে, সোহাগ করে ও প্রশংসা করে তার কাছ থেকে
কাজ আদায় করে নিতে হবে। সন্তানের প্রতি সদয় হওয়া সেই মা-বাবার পক্ষেই সম্ভব যারা নিজেরা
পরস্পরের প্রতি সদয় ও সহনশীল। আমরা প্রায়ই শুনে থাকি স্বামী দীর্ঘসময় বাইরে বন্ধু-বান্ধবের
সাথে আড্ডা মারে এবং বেশ রাতে ঘরে ফিরে। এর মূলে রয়েছে স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের বন্ধু
হতে না পারা (আল্লাহর ভাষায়-ঈমানদার নর ও নারী পরস্পরের বন্ধু)। পরস্পরের ছিদ্রান্বেষণ
ও সমালোচনা একে অপর থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। আমরা একটু সজাগ হলে আমাদের পরিবার হয়ে উঠতে
পারে শান্তি-স্বস্তি ও নিরাপত্তার কেন্দ্র। হ্যাঁ, আমরা আমাদের পরিবার থেকেই ইতিবাচক
হই এবং পর্যায়ক্রমে তা সমাজ ও রাষ্ট্রে ছড়িয়ে দেই। তাহলেই সমাজ ও রাষ্ট্র পরিশুদ্ধ
হবে। কাজটা সময়সাপেক্ষ, কিন্তু অসাধ্য নয়। পরকালে নাজাত যাদের লক্ষ্য, তাদের জন্য তো
নয়ই। ০৭/০৭/২০১৭
Comments
Post a Comment