Skip to main content

২৮ এপ্রিল সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন-একটি পর্যালোচনা


গত ২৮ এপ্রিল ঢাকা উত্তর, দক্ষিণ ও চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। রাজনীতি একটি সুস্থধারায় ফিরে আসবে এবং দেশে শান্তির সুবাতাস বইবে-এ নির্বাচন নিয়ে এমন একটি আশাবাদ দেশের শান্তিপ্রিয় মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছিল। গত বছর ৫ই জানুয়ারি ভোটারবিহীন নির্বাচন এবং ১৫৩ জন সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে আসা ছিল দেশের গণতন্ত্রের জন্য একটি কলঙ্কিত অধ্যায়। নির্বাচন কমিশন ছিল বিতর্কিত এবং সাংবিধানিক একটি প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সে সময় বলেছিলেন, এ নির্বাচন একটি নিয়মরক্ষার নির্বাচন এবং শীঘ্রই সবার অংশগ্রহণমূলক একটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হবে। তখন থেকেই দেশের রাজনীতি অস্থির হয়ে পড়লেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা এবং জাতিসংঘ মহাসচিবসহ কূটনীতিকদের প্রচেষ্টায় দীর্ঘ একটি বছর আন্দোলন-সংগ্রাম তেমন হয়নি বা বিএনপি করেনি। এ বছর ৫ই জানুয়ারি বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ২০ দল রাজধানীতে একটি সমাবেশ করতে চাইলে সরকার বাধা প্রদান করে এবং সড়ক ও জলপথ অবরোধ করে ঢাকাকে সারাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। তখন থেকেই শুরু হয় বিরোধী দলের লাগাতার হরতাল-অবরোধ ও সরকারের চরম দমন-পীড়ন। বহু লোক পেট্রল বোমায় দগ্ধ হয়ে মারা যায় এবং সরকারের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হতে বিরোধী দলের বহু নেতা-কর্মী গুম-খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের শিকার হন। বিরোধী দলের আন্দোলন-সংগ্রাম থেকে জনগণের দৃষ্টিফেরানো বা ফাঁকা মাঠে গোল দেয়ার লক্ষ্যে অর্থাৎ ঢাকা ও চট্টগ্রামের কর্তৃত্ব নিজেদের হাতে নেয়ার জন্য সরকার সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন ঘোষণা করেন। বিদেশী কূটনীতিক ও দেশের সুশীল সমাজের একটি অংশের পরামর্শে বেগম খালেদা জিয়া নির্বাচনে রাজী হন এবং চ্যালেঞ্জ হিসেবে এ নির্বাচনকে গ্রহণ করে নিজেই প্রচারণায় নেমে পড়েন। মানুষের মধ্যে অভূতপূর্ব সাড়া দেখে সরকার ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন এবং খালেদা জিয়া নির্বাচনী প্রচারণা থেকে যাতে সরে আসেন সে জন্য পরপর তিন দিন তাঁর গাড়ীবহরে হামলা হয়। তাতে আওয়ামী লীগ আরো অপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং সরকার তার গোয়েন্দা রিপোর্টের ভিত্তিতে বুঝে ফেলে যে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে সরকার মারাত্মকভাবে হেরে যাবে।তখন বিজয়ী হওয়ার জন্য সরকার ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে এবং তাতে সহযোগী হিসেবে পায় নির্বাচন কমিশন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। সরকারের প্রভাবশালী এক মন্ত্রী বলেই ফেলেন-‘নির্বাচনে কিভাবে বিজয়ী হতে হয় তা আওয়ামী লীগ জানে।‘ লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডতো নয়ই বরং বিরোধী দলকে নির্বাচনী মাঠ থেকেই সরিয়ে দেয়া হয়। জামিনতো দূরে থাক অনেক প্রার্থী নির্বাচনী প্রচারকালে আটক হন এবং অনেকেই গ্রেফতার আতঙ্কে পালিয়ে বেড়াতে থাকেন। ভোটকেন্দ্রে সম্ভাব্য এজেন্টরা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর টার্গেটে পড়ে। এত কিছুর পরও সরকার নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার ব্যাপারে সন্দিহান হয়ে পড়ে। অবশেষে সেনাবাহিনী নামানোর ঘোষণা থেকে সরে এসে নির্বাচন কমিশন নতুন করে চিঠি দেয় যে, সেনাবাহিনী সেনানিবাসেই অবস্থান করবে এবং প্রয়োজনে ডাকা হলে তারা সহায়তা দান করবে। নির্বাচন কমিশনে আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত সভায় RAB, পুলিশ ও বিজিবি জানিয়েছিল যে নির্বাচনে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় তারাই যথেষ্ট এবং সেনাবাহিনীর কোন প্রয়োজন নেই। কিন্তু নির্বাচনের দিন চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। আগেই প্রতিটি ভোটকেন্দ্র সরকার সমর্থকরা দখলে নিয়ে নেয় এবং অলি-গলিতে তারা পাহারা বসায়। বিরোধী দলের কোন এজেন্টকেই কেন্দ্রে প্রবেশ করতে দেয়া হয় না এবং দুই ঘন্টার মধ্যেই নির্বাচন শেষ হয়ে যায়। ৫ই জানুয়ারি বিরোধী দলের বর্জনের ফলে সে নির্বাচন ছিল এক তরফা। কিন্তু এবারে সবার অংশগ্রহণে হলেও ভোট ডাকাতির ফলে নির্বাচনী ব্যবস্থাপনাটিই লন্ডভন্ড হয়ে যায় এবং প্রমাণিত হয় যে, এ দেশে দলীয় সরকারের অধীনে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয়। দুপুরের মধ্যে বিএনপি তথা ২০ দল নির্বাচন থেকে সরে আসলে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন যে আশা জাগিয়েছিল তা নস্যাত হয়ে যায়।

বিরোধী দল, শত নাগরিক কমিটি, জাতিসংঘসহ বিদেশী কূটনীতিক, দেশের সকল ইলেট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া একযোগে বলে যে, এ নির্বাচনে চরম জালিয়তি ও ভোট ডাকাতি হয়েছে এবং জনমতের কোন প্রতিফলন ঘটেনি। মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেন যে, যেন-তেন ভাবে জেতা জেতা নয় এবং নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি বলে আমাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য তথ্য রয়েছে। পক্ষান্তরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীবর্গ, নির্বাচন কমিশন ও সহস্র নাগরিক কমিটি বলেন য়ে, এবারের নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে। জাতিসংঘ মহাসচিবের সাথে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ফোনালাপে তিনি বলেন যে-কোন হতাহত ছাড়াই এ নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হয়েছে। দু’টি বক্তব্য সম্পূর্ণ বিপরিতমুখি এবং একই সাথে দু’ধরনের বক্তব্য সত্য হওয়া সম্ভব নয়। দেশী-বিদেশী সকল পত্র-পত্রিকা, মিডিয়া ও কূটনীতিকদের পর্যবেক্ষণ হলো নির্বাচন মোটেই সুষ্ঠু হয়নি। নির্বাচন নিয়ে সরকার যে মিথ্যাচার করছে তাতে বিদেশে সরকারের ভাবমর্যাদা দারুণভাবে ক্ষুণ্ন হচ্ছে এবং সরকারের সকল বক্তব্যই সন্দিহান হয়ে পড়ছে।

আসলে আমাদের রাজনীতিই কলুষিত হয়ে পড়েছে। এর মূলে রয়েছে ধর্মনিরপেক্ষ দর্শন।রাজনীতিতে নীতি-নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ সব ধ্বংস হয়ে গেছে। রাজনৈতিক প্রচারণা মাজার জিয়ারতের মাধ্যমে শুরু হলেও ভোট ডাকাতি, ভোট কারচুপি, রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাৎ, অপরের ওপর জুলুম-নির্যাতন-নিপীড়ন সবই যে গুনাহের কাজ এবং পরিণতি জাহান্নাম-এ বোধ-উপলব্ধি থেকে রাজনীতিবিদরা মুক্ত। তাদেরকে বলতে শোনা যায়-রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। একটি মিথ্যা বারবার বললে তা সত্যে পরিণত হয়। ধর্ম পবিত্র জিনিস, ধর্মকে রাজনীতিতে আনা ঠিক নয়। রাজনীতি অঙ্গনে এ সবেরই চর্চা। আবার রাজনীতি সম্পর্কে জনগণের ধারণাও ভালো নয়। কেউ কারো সঙ্গে ধোকা-প্রতারণা করলে তাৎক্ষণিক বলে ওঠে-তুমি কি আমার সঙ্গে রাজনীতি করছো বা তুমি কি আমার সঙ্গে Politics করছো? শতকরা নব্বই ভাগ মুসলমানের দেশে রাজনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষ দর্শন রাজনীতি জনকল্যাণে না হয়ে জনদুর্ভোগে পরিণত হয়েছে। অথচ ইসলামের দৃষ্টিতে রাজনীতির লক্ষ্যই হলো জনকল্যাণ। তাই মক্কায় চরম দু:সময়ে সাহাবীদেরকে রসূল (সা.) শুনিয়েছিলেন-‘সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন একজন ষোড়শী যুবতী সানা থেকে হাজরা মাওত একাকী হেঁটে যাবে, তাকে আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ভয় করতে হবে না।‌‘ একটি নিরাপদ সমাজের তিনি স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। রসূল (সা.) বলেছেন-ন্যায়পরায়ণ শাসক ও বিচারক কিয়ামতের ভয়াবহ দিনে আল্লাহর আরশের ছায়ার নীচে স্থান পাবে। আজ রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সীমাহীন দুর্নীতি, লুটপাট, অনিয়মের কারণে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ইসলামের প্রতি বিশ্বাস ও আখিরাতে জবাবদিহির অনুভূতি থাকলে এ সব দুর্নীতি কখনই সম্ভব হত না। আমরা রসূল (সা.)-এর বাণী একটু স্মরণ করতে পারি-ঘুষ দানকারী ও গ্রহণকারী উভয়ই দোযখী। আমরা কাউকে দায়িত্ব প্রদান করলে সে যদি এক টুকরা সূতা বা তার চেয়েও ক্ষুদ্র জিনিস খেয়ানত করে তাহলে কিয়ামতের দিন খেয়ানতের বোঝা মাথায় করে সে উত্থিত হবে। তিনি আরো বলেন-আমরা কাউকে দায়িত্ব প্রদান করলে সে তার নিজের কাজ যত নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে করে, সরকারি দায়িত্ব যদি সেভাবে পালন না করে তাহলে কিয়ামতের দিন তাকে উল্টা করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। রাজনীতির অঙ্গনে ধর্মকে যথাযতভাবে অনুসরণ করলে এ সমাজ হয়ে উঠতো এক স্বর্গীয় সমাজ-যেখানে থাকতো না মারামারি-হানাহানি, জুলুম-নির্যাতন ও মিথ্যাচার। তাহলে এমন সমাজ কি কেবল কল্পনাতেই রয়ে যাবে। না, তা এখনো সম্ভব এবং সে জন্য প্রয়োজন ইসলামের ভিত্তিতে একটি শক্তিশালী আদর্শবাদী দলের, যারা তাদের আদর্শের খাতিরে সব কিছু ত্যাগ করার জন্য প্রস্তত থাকবে। তার একটা সম্ভাবনা দেখা দেয়ায় আজ বিশ্বব্যাপি আদর্শবাদী দলের ওপর সীমাহীন নিপীড়ন-নির্যাতন নেমে এসেছে। শত জুলুম-নির্যাতনে এ দল যদি মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে তাহলে আগামীতে বিশ্ব একটি নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা অবলোকন করবে ইনশা-আল্লাহ। আমরা সেদিনের প্রতীক্ষায়। ০৫/০৫/২০১৫


Comments