namaj shikkha নামাজ পড়ার নিয়ম জানা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য জরুরি। নিয়ম না জানলে ভুল হওয়া স্বাভাবিক। নিয়মের মধ্যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে মতভেদ থাকলেও ফরজ ও ওয়াজিব বিষয়ে সবাই একমত। আসুন আল্লাহর রাসূল কিভাবে নামাজ পড়তেন জেনে নিই।
মদীনায় হিজরত করার পর একটা অনুকূল পরিবেশে নিজের বাড়ীঘরের চিন্তা না করে সমাজে নামাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রসুল সা. প্রথমেই গড়ে তোলেন একটি মসজিদ। সেই মসজিদের ইমাম ও খতিব হলেন তিনি এবং মদীনায় মসজিদকেন্দ্রিক যে রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে উঠলো তিনি হলেন তার রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধান, প্রধান বিচারপতি ও সেনাপ্রধান।
মসজিদ সংলগ্ন ছিল তাঁর বাসভবন এবং সে মসজিদই ছিল তাঁর সচিবালয়। তিনি অত্যন্ত কর্মব্যস্ত এবং শত ব্যস্ততার মাঝে নামাজই ছিল তাঁর কাছে প্রধান অগ্রাধিকার ও পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ তিনি জামায়াতের সাথেই আদায় করতেন। তিনি তাঁর সাথীদের কাউকে এমন কি অন্ধ সাহাবী উম্মে মাকতুমকেও জামায়াতে আসা থেকে অব্যাহতি দেন নি। namaj shikkha
কয়েক ওয়াক্ত জামায়াত থেকে কেউ অনুপস্থিত থাকলে তার সম্পর্কে কানাঘুঁষা শুরু হয়ে যেত যে সে মুনাফিক হয়ে গেছে। কোন ব্যক্তি নিজেকে মুসলিম দাবী করবে অথচ জামায়াতে শরীক হবে না এটা সে সময়ে ছিল একটা অসম্ভব ব্যাপার। জামায়াতের ব্যাপারে কোন শৈথিল্য তিনি মেনে নিতেন না এবং নিজেও চরম অসুস্থতার মাঝে সাহাবীদের কাঁধে ভর করে জামায়াতে হাজির হতেন।
রসুল সা. পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ সাহাবীদের উপস্থিতিতে ইমাম হিসেবে আদায় করেছেন। সাহাবায়ে কেরাম হুবুহু তাঁকে অনুসরণ করেছেন এবং তিনি বলেছেন, ‘তোমরা নামাজ পড় যেভাবে আমাকে নামাজ পড়তে দেখ’-বুখারি।
গত বছর সস্ত্রিক হজ্বে যাওয়ার তাওফিক আল্লাহপাক আমাদেরকে দিয়েছিলেন। দেড়টা মাস মক্কা ও মদীনায় নামাজ আদায়ের সুযোগ এবং সউদী আরবের গ্রান্ড মুফতি শায়খ আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বাজ রহ.-এর লেখা নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নামাজ পড়ার পদ্ধতি বইটি পড়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। বইটি পড়ে নামাজ পড়ার নিয়ম সম্পর্কে জেনেছি।
দেড় মাস মক্কা-মদীনায় অবস্থান করে সেখানে নামাজ আদায় ও বইটি পড়ার পর আমার নিজের উপলব্ধি হলো নামাজে যে বিনয় অবলম্বনের কথা বলা হয়েছে (নিশ্চয়ই সফলকাস হয়েছে মু’মুমিনগণ যারা নিজেদের নামাযে বিনয় অবলম্বন করে-আল মু’মিনুন ১-২) বইটি যথাযথ অনুসরণের মাধ্যমে তা অনেকখানি অর্জন সম্ভব। namaj shikkha
কারও নামাজ আদায় ভুল প্রমাণ করা আমার উদ্দেশ্য নয় বরং নামাযে কিভাবে আরো আন্তরিক ও নিষ্ঠাবান হওয়া যায় সেটাই উদ্দেশ্য। নামাযে ভুল তখনই হয় যখন নামায়ে ফরজ ওয়াজিবে ত্রুটি ঘটে যায়। যেমন নামাজ আদায়ে ফরজ ভুল হলে নামাজ পুনরায় আদায় করতে হয় আর ওয়াজিবে ত্রুটি হলে সাহু সিজদার মাধ্যমে তা সংশোধন করে নেয়া যায়। সুন্নাত-মুস্তাহাবের ত্রুটি ধর্তব্যের বাইরে।
রসুল সা. নামাযের পূর্বে উত্তমভাবে অযু করতেন এবং কোন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিশেষ করে পায়ের আঙ্গুলগুলো ও গোড়ালি যাতে শুষ্ক না থাকে সেদিকে সতর্ক করতেন।
হযরত আবু হুরায়রাহ রা. থেকে বর্ণিত, ‘রসুলুল্লাহ সা. একদিন আমাদের সাথে যাচ্ছিলেন, লোকগণ তখন পানির পাত্র থেকে পানি নিয়ে অযু করছিল। তিনি বললেন অযু সুষ্ঠুরূপে কর, আমি রসুলুল্লাহ সা.-কে বলতে শুনেছি, ধ্বংস শুষ্ক গোড়ালির লোকদের জন্য, তা দোযখের আগুনে দগ্ধীভূত হবে’-বুখারি ১৬১। নামাজ পড়ার নিয়ম মানার ক্ষেত্রে তাই অযুর গুরুত্ব অনেক।
তিনি অযু করার পর দু’ রাকাত নামাজ আদায়ের অনেক ফজিলতের কথা বলেছেন (বুখারি ১৫৬)। মসজিদে প্রবেশ করে বসার আগে তিনি দু’ রাকাত নামাজ আদায়ের তাগিদ দিয়েছেন। হযরত আবু কাতাদাহ সালমী রা. থেকে বর্ণিত, ‘রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, তোমাদের কেউ মসজিদে প্রবেশ করলে বসার আগে সে যেন দু’ রাকাত নামাজ পড়ে নেয়’-বুখারি ৪২৫। এমন কি জুমার দিন তাঁর খুতবারত অবস্থায় কেউ আসলে তাকে প্রথমেই দু’ রাকাত নামাজ পড়ে নিতে বলেন- বুখারি ৮৭৭, ৮৭৮।
নামাযের সামনে দিয়ে চলাচলকে বড় গুনাহ, সুতরাহ ব্যবহার এবং জামায়াতে নামাযে ইমামের সুতরাহ মুক্তাদির জন্য যথেষ্ট বলেছেন। হযরত আনাছ রা. থেকে বর্ণিত, ‘আযানের বাক্যগুলো জোড়ায় জোড়ায় এবং ক্কাদক্কা মাতিছছালাহ ছাড়া একামতের বাক্যগুলো একবার করে বলার জন্য বেলাল রা.-কে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল’-বুখারি ৫৭০ যা মক্কা ও মদীনায় অনুসরণ করা হয়।
namaj shikkha হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. থেকে বর্ণিত, ‘তিনি বলেন, আমি দেখেছি রসুলুল্লাহ সা. নামাজ পড়তে দাঁড়িয়ে তাকবীরে তাহরীমায় দু’হাত তুলেছেন। তা কাঁধ বরাবর উঠেছে। রুকুর তাকবীর বলার সময়ে তিনি এরূপ করতেন এবং রুকু থেকে মাথা উঠাবার সময়েও এরূপ করতেন এবং সামিল্লাহুলিমান বলতেন, তবে সিজদার সময়ে এরূপ করতেন না’-বুখারি ৬৯২।
এরূপ বর্ণনা বুখারি শরীফের ৬৯১, ৬৯৪ ও ৬৯৫ তেও রয়েছে (মোট ২২ জন সাহাবী বর্ণনা করেছেন)। ৬৯৫ নং হাদিসে বলা হয়েছে তিন ও চার রাকাত নামাযে দু’ রাকাত শেষে যখন দাঁড়াতেন তখনও দু’ হাত তুলতেন। এরূপ বর্ণনা আলী রা. থেকেও রয়েছে (আবু দাউদ, আহমদ, তিরমিযি)।
ইবনে মাসউদ রা. থেকে একটি বর্ণনা রয়েছে যে রসুল সা. কেবল তাকবীরে তাহরীমার সময় হাত উত্তোলন করেছেন যেটা তিরমিযি শরীফে উল্লেখ করা হয়েছে। অবশ্য বহুসংখ্যক হাদিস বিশারদ এর সমালোচনা করেছেন এবং বলেছেন যে তিনি ভুলে যান।
রসুল সা. তাকবীরে তাহরীমার মাধ্যমে নামাজ শুরু করতেন। আমাদের সমাজে প্রচলিত জায়নামাযের দোয়া ও নাওয়াইতুয়ান উছাল্লি বলে মুখে কোন কিছু উচ্চারণ করতেন না। তাকবীরে তাহরীমার পর তিনি কিছু সময় চুপ থাকতেন। সে সময় তিনি বিভিন্ন দোয়া পড়তেন। নামাজ পড়ার নিয়ম
আবু হুরায়রা রা. বর্ণিত, তিনি বলেন ‘হে মাবুদ! পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে যেরূপ দূরত্ব রয়েছে আমার এবং আমার গুনাহের মধ্যে তদ্রুপ ব্যবধান সৃষ্টি করে দাও। হে মাবুদ! সাদা কাপড়কে ময়লা থেকে যেরূপে পবিত্র করা হয় তদ্রুপ আমাকে গুনাহ থেকে পবিত্র কর। হে মাবুদ! আমার গুনাহ ও পাপরাশিকে তুমি পানি, বরফ এবং তুষার দিয়ে ধৌত করে দাও’-বুখারি ৭০০।
namaj shikkha আলী রা. বর্ণিত, সে সময় রসুল সা. বলতেন- যিনি আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, আমি একনিষ্ঠভাবে ও আত্বসমর্পণকারী হিসেবে তার দিকে মুখ ফেরালাম, আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই। আমার নামাজ, আমার কুরবানি, আমার জীবন ও আমার মরণ সারা বিশ্বের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য। তাঁর কোন শরীক নেই। আমি এ জন্যই আদিষ্ট হয়েছি এবং আমি প্রথম আত্বসমর্পণকারী।
হে আল্লাহ, আপনিই একমাত্র বাদশাহ। আপনি ছাড়া আর কোন ত্রাণকর্তা নেই। আপনি আমার প্রভু এবং আমি আপনার বান্দা। আমি নিজের ওপর জুলুম করেছি। আমি আমার গুনাহ স্বীকার করছি। কাজেই আমার সমস্ত গুনাহ মাফ করে দিন। আপনি ছাড়া আর কেউ গুনাহ মাফ করতে পারেনা। আমাকে সর্বোত্তম চরিত্রের দিকে পরিচালিত করুন। আপনি ব্যতিত আর কেই সর্বোত্তম চরিত্রের পথে চালাতে পারে না।
খারাপ চরিত্র আমার থেকে দূরে সরিয়ে দিন। আমার থেকে খারাপ চরিত্র দূরে সরানোর ক্ষমতা আপনার ব্যতিত আর কারো নেই। আপনার আহবানে পুনঃ পুনঃ সাড়া দিচ্ছি। আপনার দ্বীনের পুনঃ পুনঃ আনুগত্য ও পুনঃ পুনঃ সাহায্য করতে আমি প্রস্তুত। যা কিছু ভালো তার সবই আপনার হাতে। যা কিছু মন্দ তা থেকে আপনি মুক্ত। আমি শুধু আপনার সাথে রয়েছি এবং শুধু আপনার নিকটই ফিরে আসবো। আপনি কল্যাণময় ও মহান। আপনার নিকট ক্ষমা চাই ও তওবা করি। (আহমদ, মুসলিম তিরমিযি, আবু দাউদ)।
উমর রা. বর্ণিত, তিনি তাকবীরে তাহরীমার পরে বলতেন ‘সুবহানাকা আল্লাহুম্মা ওয়া বিহামদিকা ওয়া তাবারাকাসমুকা ওয়া তায়ালা জাদ্দুকা, ওয়া লা ইলাহা গায়রুকা (হে আল্লাহ! আপনার পবিত্রতা ঘোষণা করি ও প্রশংসা করি। আপনার নাম কল্যাণময়, আপনার মহত্ত্ব সর্বোচ্চ এবং আপনি ব্যতিত আর কোন ইলাহ নেই -মুসলিম। এরপর আউজু ও বিসমিল্লাহ পড়ার পর সূরা ফাতিহা পড়তেন। উচ্চস্বরে নামাজে আওয়াজ করে এবং চুপিস্বরে নামাযে চুপে চুপে আমীন বলতেন।
হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত। রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, ইমাম যখন (সূরা ফাতেহার শেষ আয়াত) গাইরিল মাগদুবি আলাইহিম ওয়ালাদ্দোয়ালিন উচ্চারণ করেন তখন তোমরা আমীন বলবে। কেননা যার কথা ফেরেশতাদের কথার সাথে মিলে যায় তার পূর্ববর্তী সমস্ত গুনাহ মার্জনা করা হয়’-বুখারি ৭৩৮।
হযরত উবাদাহ ইবনে ছামেত রা. থেকে বর্ণিত, ‘তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, যে ব্যক্তি নামাযে সূরা ফাতিহা পাঠ করলো না, তার নামাজই হলো না’ বুখারি ৭১২।
( নামাজ পড়ার নিয়ম ) প্রকাশ্য নামাজে ইমামের কিরাতই মুক্তাদির কিরাত এবং গোপন নামাজে মুক্তাদির ফাতিহা পড়া হাদিসের বক্তব্যের সাথে সামঞ্জস্যশীল। নামাজ শেষে প্রচলিত মোনাজাত রসুল সা.-এর জীবনে লক্ষ্য করা যায় না। বরং তিনি তাকবীরে তাহরীমার পর, রুকু-সাজদায়, দু’ সিজদার মাঝখানে, তাশাহুদ পাঠের পর মোনাজাত করেছেন। আর আল্লাহপাকের নির্দেশনাও তাই-‘হে ঈমানদার লেকেরা! ধৈর্য ও নামাযের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য চাও’। সর্বসম্মত মত হলো সালাম ফেরানো হলে নামাজ শেষ হয়ে যায়।
তাই রসুল সা.-এর পদ্ধতি মোতাবেক আমাদেরকে আল্লাহর কাছে চাইতে হবে। হজ্বে দেড় মাস মক্কা-মদীনায় নামাজ পড়লাম কিন্ত কোন এক ওয়াক্তেও আমাদের দেশের মত প্রচলিত মোনাজাত করা হল না। রসুল সা. নামাযে তেলাওয়াত এবং রুকু সেজদাসহ সব কার্যক্রম খুব ধীর-স্থিরভাবে সম্পন্ন করতেন।
হযরত বারাআ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রসুলুল্লাহ সা.-এর রুকু ও সিজদাহ, রুকু থেকে মস্তক উত্তোলন করা এবং দু’ সিজদাহর মধ্যকার বিরতি এ গুলোর সময় প্রায় একই পরিমাণ হত’-বুখারি ৭৫৭। তিনি রুকু ও সিজদায় আল্লাহর কাছে দোয়া করতেন।
হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সা. তাঁর নামাযে রুকু ও সেজদায় ‘সুবহানাকা আল্লাহুম্মা ওয়া বিহামদিকা আল্লাহুম্মাগফিরলী’ (হে আল্লাহ! আমি তোমার পবিত্রতা ঘোষণা করছি। তোমার প্রশংসার সাথে তোমাকে স্মরণ করছি। হে আল্লাহ! আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও) পাঠ করতেন’ বুখারি ৭৫০।
তিনি রুকু থেকে সোজা দাঁড়াতেন এবং একদিন রুকু থেকে মাথা তুলার সময় সামিআল্লাহু লিমান হামিদাহ বললে পেছনে মুক্তাদিদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তি বলে উঠলো ‘রাব্বানা ওয়া লাকাল হামদ, হামদান কাছিরান, তাইয়্যিবান মুবারাকান ফিহী’। নামাজ শেষ করে রসুলুল্লাহ সা. জিজ্ঞেস করলেন, কে কথা বলছিলে? লোকটি বললো, আমি বলেছি। তখন রসুলুল্লাহ সা. বললেন, আমি দেখলাম (তা বলার সাথে সাথে) ত্রিশ জনেরও অধিক ফেরেশতা সর্বাগ্রে কে লিখবে তা নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু করে দিয়েছে’-বুখারি ৭৫৫।
রুকু থেকে সোজা দাঁড়াবার পর কিছু সংখ্যক লোকের নাম উল্লেখ করে তাদের কল্যাণ এবং কিছু লোকের ধ্বংস কামনা করেও দোয়া করেছেন তিনি -বুখারি ৭৫৯। দু’ সিজদার মাঝে তিনি সময় নিয়ে বসতেন এবং পড়তেন ‘আল্লাহুম্মাগফিরলী ওয়ার হামনী ওয়া আফিনী ওয়া আহ্দিনী ওয়ার যুকনী’ (হে আল্লাহ! আমাকে ক্ষমা করো, আমার ওপর দয়া করো, আমাকে সঠিক পথ দেখাও, আমাকে জীবিকা দাও)।
বেজোড় রাকআতে সিজদাহ থেকে দাঁড়াবার সময় তিনি একটু অপেক্ষা করতেন যাকে প্রশান্তির বৈঠক বলা হয়। হযরত মালেক ইবনে হুওয়াইরিছ লাইছি রা. থেকে বর্ণিত, তিনি রসুলুল্লাহ সা.-কে নামাজ পড়তে দেখেছেন। তিনি যখন নামাযের বেজোড় রাকআতের সিজদাহ থেকে উঠতেন, তখন কিছু সময় ঠিকভাবে না বসে দাঁড়াতেন না-বুখারি ৭৭৭।
রসুল সা. সিজদায় বেশি করে নিজে দোয়া করেছেন এবং সাহাবীদেরকে দোয়া করার জন্য এভাবে বলেছেন, ‘রুকুতে তোমরা আল্লাহর মহত্ব বর্ণনা কর, আর তোমরা সিজদার মধ্যে দোয়ার চেষ্টা কর। কেননা দাঁড়ানোর সাথে সাথেই তোমাদের দোয়া কবুল করা হয়’। তিনি আরো বলেন, ‘বান্দাহ যখন সিজদায় থাকে তখন আল্লাহর খুব নিকটবর্তী হয়ে যায়’।
তাই ফরজ বা নফল যে কোন নামায়ে সিজদার মধ্যে আল্লাহর কাছে নিজের, পরিবারের ও অন্যান্য মুসলমানের দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ কামনা করে দোয়া করতে হবে। সিজদায় রসুল সা.-এর বিভিন্ন দোয়া উল্লেখ রয়েছে।
আয়েশা রা. বর্ণনা করেছেন, রসুল সা. একদিন সিজদায় বলছেন, ‘হে আমার প্রতিপালক, আমাকে সংযম দাও, আমাকে পবিত্র করো, তুমিই সর্বোত্তম পবিত্রকারী, তুমি আমার অভিভাবক ও মনিব’-আহমদ। আবু হুরায়রা রা. বলেছেন, রসুল সা. সিজদায় বলতেন, ‘হে আল্লাহ! আমার ছোট ও বড়, পূর্বের ও পরের, গোপন ও প্রকাশ্য সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করো’-মুসলিম, আবু দাউদ।
শেষ বৈঠকে তাশাহুদ এবং দরুদে ইবরাহিম পড়ার পর আল্লাহর কাছে চাওয়ার উপযুক্ত সময়। আবু হুরায়রা রা. বর্ণনা করেছেন, রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, তোমরা শেষ তাশাহুদ পড়ার পর চারটি জিনিস থেকে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করে বলবে, আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিন আজাবি জাহান্নাম, ওয়া মিন আজাবিল কাবরি ওয়া মিন ফিতনাতিল মাহ্ইয়া ওয়াল মামাতি, ওয়া মিন র্শারি ফিতনাতিল মাসিহিল দাজ্জাল (হে আল্লাহ! আমি তোমার আশ্রয় চাইছি জাহান্নামের আযাব থেকে, কবরের আযাব থেকে, জীবন ও মৃত্যুর ফিতনা থেকে এবং দাজ্জালের অনিষ্ট থেকে)।
আলী রা. বলেছেন,রসুলুল্লাহ সা. যখন নামাজ পড়তেন, তাশাহুদ ও সালাম ফেরানোর মাঝে তাঁর সর্বশেষ দোয়া ছিল: আল্লাহুম্মাগফিরলী মা কাদ্দামতু ওয়া মা আখ্খারতু ওয়া মা আসরারতু ওয়া মা আ’লাংতু ওয়া মা আসরারতু ওয়া মা আংতা আ’লামুবিহি মিন্নি আংতাল মুকাদ্দিমু ওয়া আংতুল মুআখ্খির, লা ইলাহা ইল্লা আংতা
(হে আল্লাহ! আমার আগের ও পরের, গোপন ও প্রকাশ্য, সীমালংঘনজনিত এবং আমার চেয়েও তুমি বেশি জানো এমন সকল গুনাহ মাফ করে দাও। তুমি এগিয়ে দাও এবং তুমি পিছিয়ে দাও। তুমি ছাড়া কোন ইলাহ নেই’- মুসলিম।
আব্দুল্লাহ বিন ওমর রা. বলেন, আবু বকর রা. রসুলুল্লাহ সা. কে বললেন, নামাযে পড়বো এমন একটি দোয়া আমাকে শিখিয়ে দিন। তিনি বললেন, বলো: আল্লাহুম্মা ইন্নি জালামতু নাফসি জুলমান কাছিরান ওয়া লা ইয়াগফিরুজ্জুনুবা ইল্লা আংতা ফাগফিরলী মাগফিরাতুন মিং ইংদিকা ওয়ারহামনি ইন্নাকা আংতাল গাফুরুর রহীম
(হে আল্লাহ! আমি নিজের ওপর অনেক জুলুম করেছি (অর্থাৎ অনেক গুনাহ করেছি)। আর তুমি ছাড়া কেউ গুনাহ মাফ করতে পারেনা। সুতরাং তুমি নিজের পক্ষ থেকে আমাকে ক্ষমা করে দাও এবং আমার ওপর করুণা কর। নিশ্চয়ই তুমি ক্ষমাশীল ও করূণাময়-বুখারি, মুসলিম।
এভাবে সালামের পূর্বে অসংখ্য দোয়া রয়েছে এবং রসুল সা. ও সাহাবায়ে কেরাম নামাযের মধ্যেই আল্লাহর কাছে চাইতেন। আমাদেরও ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কল্যাণের জন্য আল্লাহর কাছে ইচ্ছা মোতাবেক চাইতে হবে। পিতা-মাতা, আত্বীয়-স্বজন ও অন্যান্য মুসলমানের কল্যাণ কামনা করে দোয়া করতে হবে।
হুজুর ছাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম যখন ইবনে মাসউদকে রা. তাশাহুদ শিক্ষা দিচ্ছিলেন তখন বলেছেন- তোমার কাছে যে দোয়া পছন্দনীয় তা নির্বাচন করে প্রার্থনা কর। অন্যভাবে আছে ‘যা ইচ্ছা তাই আল্লাহর যাঞ্ছা কর’। এগুলো মানবমন্ডলীর ইহলৌকিক ও পারলৌকিক সার্বিক মঙ্গলের ইংগিত বহন করে। তৎপর আস্সালামু আলাইকুম বলে ডান ও বাম দিকে সালাম ফিরায়ে নামাজ সমাপ্ত করতে হবে।
এ সময়ে রসুল সা. মুসল্লীদের সাথে করে হাত উঠায়ে কোন মোনাজাত করেননি। এ সুন্নাত মক্কা-মদীনায় এখনও অব্যাহত রয়েছে। বৃষ্টির জন্য বিশেষ নামাযেই কেবল তিনি হাত উঠায়ে দোয়া করেছেন। হযরত আনাস ইবনে মালেক রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সা. বৃষ্টির প্রার্থনা ছাড়া অন্য কোন ক্ষেত্রে তাঁর দোয়ার মধ্যে হাত উঠাতেন না। আর তিনি হাত এতদূর উঠাতেন যে, বগলের শ্বেত অংশ দৃষ্ট হত-বুখারি ৯৬৮।
সালাম ফেরানোর পর রসুল সা. মুক্তাদীদের দিকে ফিরে বসতেন এবং কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেন। সাথে পুরুষদেরও অপেক্ষা করতে বলতেন যাতে মহিলারা স্বচ্ছন্দে গৃহে ফিরে যেতে পারেন। সাধারণত নামাজ শেষে সাহাবারা উচ্চস্বরে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করতে করতে গৃহে ফিরতেন – বুখারি ৭৯৩।
এ সময় বিভিন্ন দোয়া ও তাসবিহ পাঠ তিনি যেমন নিজে করতেন তেমনি সাহাবীদেরকে উৎসাহিত করতেন। সালাতের পর আমলসমূহ লেখা চমৎকার পোস্টার মক্কা-মদীনার মসজিদসমূহে দেয়ালের সাথে ঝুলানো রয়েছে।
হাদিসে বর্ণিত বিভিন্ন আমলসমূহের কিছু উল্লেখ করা হলো: ছাওবান রা. থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ সা. যখন নামাজ শেষে ঘুরে বসতেন তখন আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাইতেন (আস্তাগফিরুল্লাহ, আস্তাগফিরুল্লাহ, আস্তাগফিরুল্লাহ) এবং বলতেন: আল্লাহুম্মা আংতাস সালামু ওয়া মিংকাস সালামু তাবারাকতা ইয়াযাল যালালে ওয়াল ইকরাম (হে আল্লাহ! তুমি শান্তি, তোমার কাছ থেকেই শান্তি আসে, হে মহত্ত্ব ও মর্যাদার মালিক তুমি কল্যাণময়-মুসলিম।
মুয়ায বিন জাবাল রা. বলেন, রসুলুল্লাহ সা. আমাকে বলেছেন: হে মুয়ায প্রত্যেক নামাযের পরে এই দোয়াটি পড়তে ভুলোনা: আল্লাহুম্মা আইন্নি আ’লা যিকরিকা ও শুকরিকা ওয়া হুসনি ইবাদাতিকা (হে আল্লাহ! আমাকে তোমার স্মরণ, তোমার শোকর আদায় ও তোমার ইবাদত সুষ্ঠুভাবে করতে সহায্য করো-আহমদ, আবু দাউদ, নাসায়ী।
উকবা বিন আমের রা. বলেছেন, রসুলুল্লাহ সা. আমাকে আদেশ দিয়েছেন যেন প্রত্যেক ফরয নামাযের পর সূরা নাস ও ফালাক পড়ি- বুখারি, মুসলিম, আহমদ। আবু উমামা রা. বলেছেন: রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, যে ব্যক্তি প্রত্যেক নামাযের শেষে আয়াতুল কুরছি পড়ে, তার বেহেশতে যাওয়ার ক্ষেত্রে শুধু মৃত্যু না হওয়াই অন্তরায-নাসায়ী।
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন: যে ব্যক্তি প্রত্যেক ফরয নামাযের পর তেত্রিশবার সুবহানাল্লাহ, তেত্রিশবার আলহামদু লিল্লাহ, তেত্রিশবার আল্লাহু আকবর পড়বে এবং তারপর 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারীকালাহু লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু ওয়া হুয়া আ’লা কুল্লি শাইইন কাদির' পড়বে তার সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে-বুখারি, মুসলিম।
আহমদ ইবনে আবি শায়বা ও ইবনে মাজাহ উম্মে সালামা রা. থেকে বর্ণনা করেছেন, রসুলুল্লাহ সা. ফজরের নামাযের সালাম ফিরিয়ে বলতেন, আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা ইলমান নাফিয়ান ও রিযকান ওয়াসিয়ান ওয়া আ’মালা মুতাকাব্বিলা (হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে উপকারি জ্ঞান, প্রশস্ত জীবিকা ও কবুল হওয়া আমল চাই।
হাদিসে ফজর নামাজ শেষে সাতবার আল্লাহুম্মা আজিরনি মিনান নার (হে আল্লাহ! আমাকে দোযখ থেকে রক্ষা করো) এবং মাগরিবের নামাজ শেষে সাতবার আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকাল জান্নাতা আল্লাহুম্মা আজিরনি মিনান নার (হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট বেহেশত চাই এবং দোযখ থেকে পানাহ চাই) পড়ার জন্য বলা হয়েছে- আবু দাউদ,আহমদ।
এই পৃথিবীটা একটা পরীক্ষাগার। এখানে আল্লাহপাক কাউকে রোগ-শোক, কাউকে অভাব-অনটন, কাউকে জেল-জুলুম, কাউকে সন্তানহানি ইত্যাদি নানা কায়দায় পরীক্ষা নিচ্ছেন এবং এটা আল্লাহপাকের এক স্থায়ী নিয়ম। এ সব পরীক্ষায় উত্তরণের উপায় হলো ধৈর্য ও নামাজ (হে ঈমানদারগণ! ধৈর্য ও নামাজের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করো, নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন- বাকারাহ ১৫৩-১৫৪)।
রসুল সা. আমলও ছিল এমনটি। অত্যন্ত বিনয় ও নম্রতার সাথে নামাযে দন্ডায়মান হয়ে চরম আত্ববিশ্বাস নিয়ে রসুল সা.-এর শেখানো পথে আল্লাপাকের নিকট চাইতে হবে। তাঁর নিজের ভাষায় বলছেন যে তিনি বান্দার ডাক শুনেন।
আর হে নবী! আমার বান্দারা যদি তোমার কাছে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে তাহলে তাদেরকে বলে দাও, আমি তাদের কাছেই আছি। যে আমাকে ডাকে আমি তার ডাক শুনি এবং জবাব দেই, কাজেই আমার আহবানে সাড়া দেয়া ও আমার ওপর ঈমান আনা তাদের একান্ত কর্তব্য। এ কথা তুমি তাদের শুনিয়ে দাও, হয়ত তারা সত্য-সরল পথের সন্ধান পাবে (বাকারা ১৮৬)।
আমরা আল্লাহকে স্মরণ করলে অবশ্যম্ভাবী তিনি আমাদেরকে স্মরণ করবেন। এটা তাঁর ওয়াদা। (কাজেই তোমরা আমাকে স্মরণ রাখো, আমিও তোমাদেরকে স্মরণ রাখবো আর আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো এবং আমার নিয়ামত অস্বীকার করো- বাকারা ১৫২)।
আল্লাহকে স্মরণ অর্থ সকল অবস্থায় তাঁর আনুগত্য করা এবং বিনীতভাবে তাঁরই কাছে চাওয়া। নামাজ মু’মিনের চাওয়ার মাধ্যম। নামাযে হাজির হওয়া অর্থ আল্লাহরই সামনে দন্ডায়মান হওয়া এবং আত্ববিশ্বাস নিয়ে নামাযের বিভিন্ন পর্যায়ে বিশেষ করে সিজদায় ও শেষ বৈঠকে আল্লাহতায়ালার কাছে চাইতে হবে। আল্লাহর ভান্ডার অফুরন্তু এবং সময়ও অফুরন্তু। কার্পণ্য থেকে আল্লাহ মুক্ত।
কোন সময়ে বান্দার চাওয়া অপূর্ণ থাকলে তা শুধু এ কারণেই যে সেটা মালিকের দৃষ্টিতে বান্দার জন্য কল্যাণকর হবে না। আমাদের মনে রাখতে এক জন মু’মিনের পরীক্ষা কেবল তার মর্যাদা বৃদ্ধির লক্ষ্যেই। নিরবিচ্ছিন্ন সুখ বা দুখ এ পৃথিবীতে নেই এবং সুখ-দুখ মিলেই আল্লাহর এ দুনিয়া। তাই সর্বাবস্থায় সবর ও শোকর আদায় করতে হবে।
ইবাদত তখনই ইবাদত যখন তা আল্লাহ ও তাঁর রসল সা. এর মর্জিমাফিক হবে। শর্তহীনভাবে শুধুই বলতে হবে শুনলাম এবং মেনে নিলাম। নিজের পছন্দ-অপছন্দ কখনই বিবেচনায় আসবে না। ইমাম আজম আবু হানিফা রহ. সমগ্র জীবন ইসলামের সেবায় আত্বনিয়োগ করেছেন এবং ফিকাহ শাস্ত্রে তাঁর অসামান্য অবদান রয়েছে।
আমি নিজেও একজন তাঁর অনুসারী। কিন্তু কোন হাদিস ভিন্নতর পেলে সেটা অনুসরণ করতে আমি একটুও দ্বিধা করি না। ইমাম সাহেবের মত হলো যদি তাঁর মত হাদিসের বিপরিত হয় তবে হাদিসের মতই তাঁর মত। বিশাল সুন্নাতের সব কিছু আমল করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয় এবং সেটা দোষের কিছু নয় বা যেখানে ভিন্ন ভিন্ন মত আছে সেখানে যে কোন একটি অনুসরণের সুযোগ রয়েছে। namaj shikkha
কিন্তু ইবাদত হিসেবে রসুল সা. যেটা করেননি বা সাহাবীরা করেননি সেটা নিয়মিত করাটাই বিদয়াত। বিদয়াতীদের দোয়া আল্লাহ কখনই গ্রহণ করেন না এবং তাদের পরিণতি জাহান্নাম। আল্লাহপাক ইবাদতের ক্ষেত্রে বিদয়াত মুক্ত হয়ে একনিষ্ঠতার পরিচয় দানের তাওফিক দান করুন। আমীন।
Comments
Post a Comment