আজ আমাদের দেশে দুর্নীতি সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে। একজন দরিদ্র দুধবিক্রেতা দুধে পানি মেশাচ্ছে,
ফলবিত্রেতা সুযোগমত পচা ফলটা ক্রেতাকে দিয়ে দিচ্ছে, আদালতে সাক্ষী অনর্গল মিথ্যা সাক্ষ্য
প্রদান করে যাচ্ছে, চাকুরীতে অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ হচ্ছে অর্থাৎ রাজনীতিবিদ, সরকারী কর্মকর্তা-
কর্মচারী, ব্যবসায়ী, সাধারণ মানুষ কেউ দুর্নীতি থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারছে না। সম্প্রতি
দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বন্ধ করে দিয়ে বিশ্বদরবারে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ
হিসেবে আমাদের পরিচিতিকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। এর থেকে উত্তরণের উপায় কি? দেশে
দুর্নীতি দমন কমিশন রয়েছে, সরকারের নানা বাহিনী রয়েছে; দুর্নীতিকে না বলুন- পোস্টার,
ফেস্টুন, ব্যানার নিয়ে নানা রঙের র্যালি এবং সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, টেলিভিশনে নানা বিদগ্ধ
জনের আলোচনা ও পত্রিকায় কলাম লেখার মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করার নানা প্রয়াস চলছে।
কিন্তু মনে হচ্ছে উদ্বুদ্ধকরণের সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে দুর্নীতিরও প্রসার ঘটছে। হয়তবা উদ্বুদ্ধকরণের
প্রয়াসের মধ্যেও দুর্নীতি রয়েছে অর্থাৎ দুর্নীতি বিরোধী র্যালি বা সেমিনার অনুষ্ঠানেও দুর্নীতি হচ্ছে,
ত্রিশ টাকার ভাউচারকে তিনশত টাকা করা হচ্ছে। ফলে এত আয়োজন জনগণের উপর কোন
প্রভাব পড়ছে না। আমরা যদি একটু পেছন ফিরে দেখি তাহলে দেখবো আমাদের প্রিয়তম নবী
মুহাম্মদ (সাঃ)-এর আগমনকালীন সময়টিতে এমনি ধরনের বা এর চেয়ে বেশীই দুর্নীতি-অনিয়ম-
জুলুম-নিপীড়ন ছিল যার কারণে ঐতিহাসিকরা এ সময়কে আইয়ামে জাহেলিয়াত বলে আখ্যায়িত
করেছেন। ইতিহাস সাক্ষী, মাত্র ২৩টি বছরের মধ্যে ইতিহাসের সবচেয়ে অসভ্য ও বর্বর জাতিটাকে
তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে সুসভ্য জাতিতে রূপান্তরিত করেছিলেন। কোন যাদু বলে এটা সম্ভব
হয়েছিল? যাদু একটাই-তা হলো তিনি মানুষকে আল্লাহ ও আখিরাতের কথা শুনিয়েছিলেন। এ
দুনিয়ার জীবনটাই শেষ নয়। এরপর রয়েছে এক অনন্তকালের জীবন যেখানে এই পৃথিবীতে করে
যাওয়া সকল কাজের চুলচেরা বিচার বিশ্লেষণ করে ভালো কাজের প্রতিফল পরম আরাম-আয়েশের
স্থান জান্নাত এবং মন্দ কাজের প্রতিফল চরম শাস্তির স্থান জাহান্নাম প্রদান করা হবে। শুধু বিশ্বাসের
বদৌলতে একটি মানবগোষ্ঠীর আচার-আচরণ ও কর্মে বিস্ময়কর পরিবর্তন এসেছিল। আল্লাহপাক
ও তাঁর রসুল (সাঃ) নানাভাবে মানুষকে সৎ জীবন-যাপনে উদ্বুদ্ধ করেছেন। দুর্ভাগ্য- আমরাও
মানুষকে উদ্বুদ্ধ করি; কিন্তু করি তা বিশ্বাস বিবর্জিত পন্থায়। কুরআন-হাদীসের পাতায় পাতায় সৎ
জীবন যাপনের তাগিদ রয়েছে এবং সৎ জীবন যাপনে অভ্যস্ত করে তোলার জন্য আল্লাহপাক ফরয
করেছেন পাঁচ ওয়াক্ত নামায ও রমযান মাসব্যাপী রোযা। কারো বিধান পালনের জন্য প্রয়োজন
সার্বক্ষণিক তাঁর স্মরণ ও তাঁর প্রতি ভয়। আমরা যে আল্লাহর বান্দা তা নামাযের মাধ্যমে দৈনিক
পাঁচবার বিশেষভাবে স্মরণ করি এবং আল্লাহপাকের সাথে দৈনিক পাঁচবার এই প্রতিশ্রুতিই প্রদান
করে যাচ্ছি যে ‘আমরা কেবল তোমারই গোলামী করি এবং তোমারই নিকট সাহায্য কামনা করি’।
প্রতিটি অন্যায়-অপকর্ম আল্লাহপাকের অবাধ্যতা এবং আল্লাহর সঙ্গে কৃত ওয়াদার খেলাফ। আর
ওয়াদা খেলাফকারী মাত্রই মুনাফিক। নামাযের উদ্দেশ্য প্রসঙ্গে আল্লাহপাক বলেন,‘নিশ্চয়ই নামায
মানুষকে অন্যায় ও অশ্লীল কাজ থেকে বিরত রাখে’। আর রসুল (সাঃ) বলেন,‘যে নামায মানুষকে
অন্যায় ও অশ্লীল কাজ থেকে বিরত রাখে না সে নামায আল্লাহ ও মানুষের মধ্যে ব্যবধান বাড়িয়ে
দেয়’। আজকে সমাজের এই অপরাধ ও সীমাহীন দুর্নীতি এটাই প্রমাণ করে যে মুসলমানরা হয়
নামায ছেড়ে দিয়েছে না হয় লোককে দেখানো উদ্দেশ্যেই কেবল নামায পড়ে।
রোযা ফরয প্রসঙ্গে আল্লাহপাক বলেন,‘তোমাদের প্রতি রোযা ফরয করা হয়েছে যেমন করা
হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পার’। আল্লাহতা’য়ালার পক্ষ
থেকে যত শরীয়ত আসছে সকল শরীয়তেই রোযা ফরয ছিল। উদ্দেশ্য একটাই-মানুষের মধ্যে
তাকওয়ার গুণ সৃষ্টি করা। তাকওয়া অর্জনের ক্ষেত্রে রোযা অনন্য, রোযার কোন বিকল্প নেই।
ইসলামের প্রতিটি অনুশাসন পালনে কিছু লৌকিকতা-প্রদর্শনী আছে; কিন্তু রোযা তা থেকে সম্পূর্ণ
মুক্ত। যেমন, নামায আদায়ের ক্ষেত্রে সকলের সাথে মিলে মসজিদে আদায় করতে হয়, হজ্ব সকলের
সাথে দীর্ঘপথ পাড়িয়ে দিয়ে আদায় করতে হয় এবং যাকাতের ক্ষেত্রে অন্তত গ্রহীতা জানতে পারে।
কিন্তু রোযার খবর আল্লাহপাক ছাড়া আর কেউ রাখে না। সকলের সঙ্গে সেহরী খেয়ে সারাদিন
পানাহার বন্ধ রাখা কেবল আল্লাহপাকের ভয়েই সম্ভব। প্রচন্ড গরমে পিপাসায় ছটফট করে, ক্ষুধার
জ্বালায় অস্থির হয়ে পড়ে, কিন্তু লোকচক্ষুর অগোচরে কোন রোযাদার কিছুই গ্রহণ করে না। করে না,
শুধু এই কারণে যে মহান আল্লাহ আ’লিমুল গায়িব-গোপন ও প্রকাশ্য সবই তাঁর কাছে সমান-কোন
কিছুই তাঁর থেকে আড়াল করা যায় না। শুধু এই বিশ্বাসই ইফতার সামনে নিয়ে বারবার ঘড়ি দেখে
কিন্তু কোন কিছু মুখে তুলে দেয় না। এখন প্রশ্ন? নির্জনে রোযাদার কিছু খেলে যে আল্লাহ দেখেন
সেই আল্লাহই আবার লোকের অগোচরে ওজনে কম দিলে, ভেজাল দিলে, ধোঁকা-প্রতারণার আশ্রয়
নিলে, ঘুষের আদান-প্রদান করলে দেখবেন না কেন? রোযা কয়েক ঘন্টা বা ২/১ দিন নয়, টানা
ত্রিশটা দিন মুসলমানদেকে এই প্রশিক্ষণই দেয় যে, তোমাদের কোন কাজ-কর্মই আল্লাহ থেকে
গোপন নয়; তাই সর্বাবস্থায় তোমরা আল্লাহকেই ভয় কর এবং রোয়ার দিনে কেবল আল্লাহপাকের
নির্দেশে যেমন অনেক বৈধ কাজ থেকে দূরে থাক (যেহেতু সে সময় তিনি তা তোমাদের জন্য নিষেধ
করেছেন) তাই সর্বাবস্থায় আল্লাহর নাফরমানি থেকে দূরে থাক। আর এই দূরে থাকার নামই
তাকওয়া এবং এই তাকওয়া সৃষ্টিই রোযার উদ্দেশ্য। দুর্ভাগ্য মুসলমানদের-যুগ যুগ ধরে উদ্দেশ্য
বিবর্জিতভাবেই তারা রোযা পালন করে আসছে। এই রোযায় তাদের আচরণ ও চরিত্রে কোন
পরিবর্তন আসছেনা। এ প্রসঙ্গে আল্লাহর রসুল (সাঃ) বলেন, ‘এমন অনেক রোযাদার আছেন ক্ষুতপিপাসায়
কষ্ট পাওয়া ছাড়া তাদের ভাগ্যে আর কিছইু জোটে না’। ‘রোযা রেখে যে মিথ্যা ও অশ্লীল
কথা-বার্তা পরিহার করতে পারলো না, তার রোযা রাখায় আল্লাহর কোনই প্রয়োজন নেই’। হাদীসে
বলা হয়েছে রোযা অবস্থায় কেহ যদি তার সাথে ঝগড়া করতে চায় তাহলে সে বলবে ‘ভাই, আমি
রোযাদার’। এই দীর্ঘ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তার মধ্যে সকল ময়লা আবর্জনা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নিখাত
খাঁটি বানানোই রোযার উদ্দেশ্য। আর এরূপ পরিশুদ্ধ রোযাদারের জন্যই বলা হয়েছে ‘জান্নাতে
একটি স্পেশাল দরজা দিয়ে সে প্রবেশ করবে। হাশরের ময়দানে সবাই যখন পেরেশোনির মধ্যে
থাকবে তখন দেখা যাবে রোযাদার আরশের ছায়ার নিচে খানাপিনায় ব্যস্ত। যারা ঈমান ও
এহতেছাবের সাথে রোযা রাখবে আল্লাহ তার অতীতের সকল গুনাহ মাফ করে দিবেন’। এ সবই
রোযাদারের জন্য খোশখবরী। দীর্ঘ এক মাস রোযা রাখার মাধ্যমে রোযাদারের মধ্যে এমন গুণ সৃষ্টি
হয় যাতে বাকী এগারোটা মাস সে সর্বপ্রকার আল্লাহর নাফরমানি অর্থাৎ সকল পাপাচার থেকে
নিজেকে মুক্ত রাখতে পারেন। মুসলমানদেরকে অবশ্যই রোযার উদ্দেশ্যকে স্মরণে রেখে রোযা
আদায় করতে হবে। তাহলেই কেবল ব্যক্তি পরিশুদ্ধির সাথে সাথে সমাজও পরিশুদ্ধ হয়ে উঠবে।
সমাজ থেকে দুর্নীতি দূর করতে হলে ব্যাপকভাবে মানুষের মধ্যে রোযার শিক্ষা তুলে ধরতে হবে।
কিন্তু দুর্ভাগ্য-যাঁরা এই কাজটি করবে তাঁরা আজ নানাভাবে বাধাপ্রাপ্ত ও নিঃগৃহিত। সমাজে
অপরাধপ্রবণ লোকের সংখ্যা খুবই স্বল্প। অধিকাংশ মানুষকে কুরআন-হাদীসের মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ করতে
পারলে তাদের মধ্যে সৎ গুণাবলীর প্রসার ঘটবে এবং আখিরাতের জবাবদিহির অনুভূতি জাগ্রত
করতে পারলে অবশ্যই তাদের মধ্যে অসৎপ্রবণতা দূর হয়ে যাবে। এজন্য মূল ভূমিকা পালন করতে
হবে সরকারকেই। মানুষ মূলত শাসকদেরকেই অনুসরণ করে থাকে। সরকারের দায়িত্ব ভালো
কাজের প্রচার ও প্রতিষ্ঠা এবং মন্দ কাজের প্রতিরোধ।
আল্লাহপাক মানুষকে পরিশুদ্ধ করার জন্য মটিভিশন বা উদ্বুদ্ধকরণের নানা পন্থা অবলম্বন
করেছেন। মানুষকে সৎ পথে ফিরে আসার জন্য বারবার আহবান জানিয়েছেন। মানুষের দ্বারা ভুল
হবে না বা মানুষ কখনই কোন অন্যায় করবে না বা অন্যায় করলেই মানুষকে তার শাস্তি ভোগ
করতেই হবে- ইসলাম এ মত পোষণ করে না। আল্লাহপাক বারবার তাকে তাঁর পথে ফিরে আসার
জন্য বলেছেন। অন্যায় করার পর কেহ যদি তা স্বীকার করে আল্লাহর নিকট তাওবা করে এবং
সেই অপরাধের পুনরাবৃত্তি না করে তাহলে আল্লাহ গফুরুর রহীম। সৃষ্টির প্রথম মানুষ দিয়েই তিনি
তা দেখিয়ে দিয়েছেন-হযরত আদম (আঃ) ও ইবলিস উভয়ই আল্লাহর নাফরমানি করেছিলেন। কিন্তু
দুইয়ের পার্থক্য হলো-আদম (আঃ) তাৎক্ষণিক ভুল স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন কিন্তু ইবলিস
দম্ভ ও অহংকার প্রকাশ করলো। প্রতিদান হিসাবে আল্লাহপাকও তাৎক্ষণিক (আদম আঃ)-কে ক্ষমা
করে দিলেন এবং শুধু ক্ষমাই নয় নবুয়তি দিয়ে তাঁকে সম্মানিত করলেন আর ইবলিসের উপর লানত
বর্ষণ করলেন। এই রমযান মাস আমাদের গুনাহ মাফের এক অপূর্ব সুযোগ নিয়ে হাজির হয়েছে।
হাদীসের ভাষাটা বড়ই আশাব্যঞ্জক-‘যারা ঈমান ও এহতেছাবের সাথে রোযা রাখবে আল্লাহ তাদের
অতীতের সকল গুনাহ মাফ করে দিবেন।’ আর একটি বর্ণনা এভাবে-রসুল (সাঃ) মিম্বরে
আরোহনকালে বলেন, ‘এইমাত্র জিবরিল (আঃ) আমাকে বলে গেলেন, যে ব্যক্তি রমযান মাস পেল
অথচ নিজের গুনাহ মাফ করে নিতে পারলো না সে যেন ধ্বংস হয়, আমি বললাম-আমীন’। এতে
স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে কুরআনের বরকতে আল্লাহপাক এ মাসটাকে তাঁর বান্দাদের ফিরে আসার এক
সুযোগ হিসাবে রেখে দিযেছেন। কিছু নিদর্শন তো এমনিতেই লক্ষ্য করা যায়-মসজিদগুলো
মুসল্লিতে পূর্ণ হয়ে যায়, রাজনীতিবিদরা তাদের কর্মসূচি স্থগিত রাখে এবং সর্বত্র একটি পবিত্র
পরিবেশ কিছুটা হলেও লক্ষ্য করা যায়। মনে হয় বড় শয়তানটাকে শৃঙ্খলিত করার ফলেই এতটুকু
সম্ভব হয়েছে। কিন্তু শয়তানের যারা মুরিদ অর্থাৎ মানব শয়তানগুলোকে শৃঙ্খলিত করার দায়িত্ব ছিল
আল্লাহর প্রতিনিধিদের-তাদের দায়িত্ব অবহেলার কারণেই রমযানের পুরা বরকত থেকে আমরা
বঞ্চিত হচ্ছি।
মুসলমানরা ইসলামের অনুশাসনসমূহ উদ্দেশ্যবিবর্জিতভাবে বছরের পর বছর পালন করে
যাচ্ছে। সকল কাজে উদ্দেশ্যই হ’ল মুখ্য। একজন ছাত্র লেখাপড়া করে পরীক্ষা দেয়-উদ্দেশ্য একটি
ভালো ফলাফল লাভ করা; একজন ডাক্তার রোগীর চিকিৎসা করে-উদ্দেশ্য তাকে সুস্থ করে তোলা,
ঠিক তেমনি রোযা ফরয করার উদ্দেশ্য হলো মানুষের মধ্যে তাকওয়ার গুণ সৃষ্টি করা। একজন
তাকওয়াবান ব্যক্তি কোন অবস্থাতেই আল্লাহর নিষিদ্ধ কাজ করতে পারে না; এমনকি সন্দেহজনক
কাজ থেকেও সে বিরত থাকে। আমরা যে সমস্ত কাজকে দুর্নীতি বলে থাকি ইসলামের পরিভাষায় এ
সবই হারাম। সব অবৈধ কাজই মানুষ লোকচক্ষুর আড়ালে করে থাকে; কিন্তু রোযাদার ঠিকই জানে
মানুষকে আড়াল করতে পারলেও আল্লাহর চোখকে কখনই ফাঁকি দেয়া সম্ভব নয়। একটানা ত্রিশ
দিন একজন রোযাদার সে প্রশিক্ষণই লাভ করে থাকে। তাই রোয়ার শিক্ষার মাধ্যমেই একজন ব্যক্তি
ও তার সাথে সমাজকে দুর্নীতিমুক্ত করা সম্ভব হতে পারে।
আমরা একটু আলোচনা করে দেখতে পারি সমাজে যে সব কাজ দুর্নীতি হিসেবে চিহ্নিত সে
সব সম্পর্কে ইসলামে দৃষ্টিভঙ্গি কি? যেমন অফিসে সেবা পেতে হলে ঘুষ দিতে হয় এবং এর প্রসার
সর্বব্যাপি। ঘুষ সম্পর্কে আল্লাহর রসুল (সাঃ) বলেন,‘ঘুষের দাতা ও গ্রহীতা উভয়ই দোযখী।’
বিষয়টি শর্তহীন। নিতান্ত দায়ে ঠেকে যদি কেউ দিয়ে থাকে তার বিষয়টি আল্লাহর হাতে। কিন্তু যে
ঘুষ গ্রহণ করে সে সন্দেহাতীতভাবে জাহান্নামী; আর কেউ যদি এটা বিশ্বাস না করে সে মূলত রসুল
(সাঃ)-কে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করলো (নাউজুবিল্লাহ)। সরকারি অফিস-আদালতে খেয়ানত এখন
একটি সাধারণ ব্যাপার হয়ে পড়েছে। অথচ আমানত সম্পর্কে হাদীসে বলা হয়েছে,‘ঐ ব্যক্তির ঈমান
নেই যার আমানতের ঠিক নেই।’ একজন মুসলমানের প্রথম পুঁজি হ’ল তার ঈমান। যার ঈমান নেই
তার নামায, রোযা, যাকাত ও হজ্ব সবই বৃথা। ব্যাংকে বহুল প্রচলিত শব্দ ঋণ খেলাফি অর্থাৎ
ওয়াদামত ঋণ ফেরৎ না দেয়া বা রাজনীতির অঙ্গনে দেয়া প্রতিশ্রতি, বন্ধু-বান্ধবদের নিকট থেকে
নেয়া ধার বা দোকান থেকে নেয়া ধার পরিশোধে গাফেলতি কোন মুসলমানের পক্ষে কি আদৌ
সম্ভব-য়েখানে হাদীসে বলা হয়েছে,‘ঐ ব্যক্তির ধর্ম নেই যার ওয়াদা-প্রতিশ্রুতির ঠিক নেই।’ এ
জাতীয় অধার্মিক লোকদের মৃত্যুর পর জানাজা পড়ার যৌক্তিকতাই বা কি? এমন কোন অপকর্ম নেই
যা আজ মুসলমানরা না করছে। ওজনে কম দেয়া, ভেজাল দেয়া, মিথ্যা কসম খাওয়া, ধোকাপ্রতারণা
করা, পরের সম্পদ হরণ করা, নারী নির্যাতন, যৌতুক দাবী, উত্তরাধিারকে ঠকানো, মিথ্যা
সাক্ষ্য প্রদান, গীবৎ, অপরকে কষ্ট দেয়া, খুন-রাহাজানি, চুরি-ডাকাতি সবই মুসলিম নামধারীদের
দ্বারা সংঘঠিত হচ্ছে। আসলে জাতিগতভাবে বেঈমান ও অধার্মিক হওয়ারই এ সব ফলশ্রুতি।
এদের সম্পর্কেই আল্লাহর রসুল (সাঃ) সাহাবীদেরকে বলেছিলেন, ‘আমি কি বলবো তোমাদের মধ্যে
সবচেয়ে দরিদ্র কে? সাহাবীরা বলেছিলেন যাদের টাকা-পয়সা নেই। রসুল (সাঃ) বলেছিলেন-না, ঐ
ব্যক্তি দরিদ্র যে নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাত আদায়ের সাথে সাথে মানুষকে গালি দিয়েছে, অপরের
হক নষ্ট করেছে ও মন্দ কাজ করেছে। কিয়ামতের দিন যাদের হক নষ্ট করেছে তাদের পাওনা তার
নেক আমল থেকে পরিশোধ করতে হবে এবং এটা সম্ভব না হলে তাদের গুনাহর বোঝা মাথায় করে
সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে’। এরই প্রতিধ্বনি করে আমাদের অন্যতম সাহিত্যিক ইসমাইল হোসেন
সিরাজী তাঁর সাহিত্যে লিখেছেন, ‘অতি নামাযী, কালামী, হাজী, দরবেশ পাপী গুনাহগার হতে
পারেন যদি তিনি করে থাকেন সামাজিক জীবনের দুশমনি’। তিনি আরো বলেছেন, ‘যে লোক বছর
বছর হাওয়ায় জাহাজে করে হজ্ব করে আসেন, তিনি যদি তাঁর কারখানার শ্রমিককে ন্যায্য
পারিশ্রমিক না দেন তাহলে তাঁর কবরে সোনার চাবি রেখে দিয়ে আসলেও সে চাবি দিয়ে
বেহেশতের কোন দরজাই খুলতে পারবে না’। রোযা যদি আমাদের মধ্যে আল্লাহর ভয় সৃষ্টি না করে
এবং আমাদের ব্যবহারিক জীবন যদি পরিশুদ্ধ না হয় তাহলে এ রোযা অর্থহীন উপবাস ছাড়া আর
কিছু হবে না।
নিজেদেরকে বেঈমান ও অধার্মিক প্রমাণ করা আমার উদ্দেশ্য নয়। সমাজের এই কদর্য চিত্র
দেখে আমার কষ্ট থেকে এই লেখা। আমি চাই সমগ্র মুসলিম জাতি তার অতীত ঐতিহ্য ধারণ করে
আবার বিশ্বকে শাসন করুক। এ জন্য প্রয়োজন চরিত্র। রসুল (সাঃ)-এর বাণী, ‘তোমাদের মধ্যে ঐ
ব্যক্তি উত্তম যে চরিত্রের দিক দিয়ে উত্তম’। আজ মুসলমানরা চরিত্রহারা। চরিত্রবান হিসাবে গড়ে
তোলার জন্যই আল্লাহপাক মুসলমানদের প্রতি নামায-রোযার মত আনুষ্ঠানিক ইবাদতসমূহ ফরয
করেছিলেন। আসুন, রমযানের এই সূচনালগ্নে আমরা আমাদের সকল অপকর্ম থেকে তাওবা করে
গোটা জীবনটাকে পরিশুদ্ধ করি এবং আল্লাহপাকের প্রতিশ্রুত জান্নাতের উপযুক্ত হই। আমীন।
ফলবিত্রেতা সুযোগমত পচা ফলটা ক্রেতাকে দিয়ে দিচ্ছে, আদালতে সাক্ষী অনর্গল মিথ্যা সাক্ষ্য
প্রদান করে যাচ্ছে, চাকুরীতে অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ হচ্ছে অর্থাৎ রাজনীতিবিদ, সরকারী কর্মকর্তা-
কর্মচারী, ব্যবসায়ী, সাধারণ মানুষ কেউ দুর্নীতি থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারছে না। সম্প্রতি
দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বন্ধ করে দিয়ে বিশ্বদরবারে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ
হিসেবে আমাদের পরিচিতিকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। এর থেকে উত্তরণের উপায় কি? দেশে
দুর্নীতি দমন কমিশন রয়েছে, সরকারের নানা বাহিনী রয়েছে; দুর্নীতিকে না বলুন- পোস্টার,
ফেস্টুন, ব্যানার নিয়ে নানা রঙের র্যালি এবং সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, টেলিভিশনে নানা বিদগ্ধ
জনের আলোচনা ও পত্রিকায় কলাম লেখার মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করার নানা প্রয়াস চলছে।
কিন্তু মনে হচ্ছে উদ্বুদ্ধকরণের সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে দুর্নীতিরও প্রসার ঘটছে। হয়তবা উদ্বুদ্ধকরণের
প্রয়াসের মধ্যেও দুর্নীতি রয়েছে অর্থাৎ দুর্নীতি বিরোধী র্যালি বা সেমিনার অনুষ্ঠানেও দুর্নীতি হচ্ছে,
ত্রিশ টাকার ভাউচারকে তিনশত টাকা করা হচ্ছে। ফলে এত আয়োজন জনগণের উপর কোন
প্রভাব পড়ছে না। আমরা যদি একটু পেছন ফিরে দেখি তাহলে দেখবো আমাদের প্রিয়তম নবী
মুহাম্মদ (সাঃ)-এর আগমনকালীন সময়টিতে এমনি ধরনের বা এর চেয়ে বেশীই দুর্নীতি-অনিয়ম-
জুলুম-নিপীড়ন ছিল যার কারণে ঐতিহাসিকরা এ সময়কে আইয়ামে জাহেলিয়াত বলে আখ্যায়িত
করেছেন। ইতিহাস সাক্ষী, মাত্র ২৩টি বছরের মধ্যে ইতিহাসের সবচেয়ে অসভ্য ও বর্বর জাতিটাকে
তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে সুসভ্য জাতিতে রূপান্তরিত করেছিলেন। কোন যাদু বলে এটা সম্ভব
হয়েছিল? যাদু একটাই-তা হলো তিনি মানুষকে আল্লাহ ও আখিরাতের কথা শুনিয়েছিলেন। এ
দুনিয়ার জীবনটাই শেষ নয়। এরপর রয়েছে এক অনন্তকালের জীবন যেখানে এই পৃথিবীতে করে
যাওয়া সকল কাজের চুলচেরা বিচার বিশ্লেষণ করে ভালো কাজের প্রতিফল পরম আরাম-আয়েশের
স্থান জান্নাত এবং মন্দ কাজের প্রতিফল চরম শাস্তির স্থান জাহান্নাম প্রদান করা হবে। শুধু বিশ্বাসের
বদৌলতে একটি মানবগোষ্ঠীর আচার-আচরণ ও কর্মে বিস্ময়কর পরিবর্তন এসেছিল। আল্লাহপাক
ও তাঁর রসুল (সাঃ) নানাভাবে মানুষকে সৎ জীবন-যাপনে উদ্বুদ্ধ করেছেন। দুর্ভাগ্য- আমরাও
মানুষকে উদ্বুদ্ধ করি; কিন্তু করি তা বিশ্বাস বিবর্জিত পন্থায়। কুরআন-হাদীসের পাতায় পাতায় সৎ
জীবন যাপনের তাগিদ রয়েছে এবং সৎ জীবন যাপনে অভ্যস্ত করে তোলার জন্য আল্লাহপাক ফরয
করেছেন পাঁচ ওয়াক্ত নামায ও রমযান মাসব্যাপী রোযা। কারো বিধান পালনের জন্য প্রয়োজন
সার্বক্ষণিক তাঁর স্মরণ ও তাঁর প্রতি ভয়। আমরা যে আল্লাহর বান্দা তা নামাযের মাধ্যমে দৈনিক
পাঁচবার বিশেষভাবে স্মরণ করি এবং আল্লাহপাকের সাথে দৈনিক পাঁচবার এই প্রতিশ্রুতিই প্রদান
করে যাচ্ছি যে ‘আমরা কেবল তোমারই গোলামী করি এবং তোমারই নিকট সাহায্য কামনা করি’।
প্রতিটি অন্যায়-অপকর্ম আল্লাহপাকের অবাধ্যতা এবং আল্লাহর সঙ্গে কৃত ওয়াদার খেলাফ। আর
ওয়াদা খেলাফকারী মাত্রই মুনাফিক। নামাযের উদ্দেশ্য প্রসঙ্গে আল্লাহপাক বলেন,‘নিশ্চয়ই নামায
মানুষকে অন্যায় ও অশ্লীল কাজ থেকে বিরত রাখে’। আর রসুল (সাঃ) বলেন,‘যে নামায মানুষকে
অন্যায় ও অশ্লীল কাজ থেকে বিরত রাখে না সে নামায আল্লাহ ও মানুষের মধ্যে ব্যবধান বাড়িয়ে
দেয়’। আজকে সমাজের এই অপরাধ ও সীমাহীন দুর্নীতি এটাই প্রমাণ করে যে মুসলমানরা হয়
নামায ছেড়ে দিয়েছে না হয় লোককে দেখানো উদ্দেশ্যেই কেবল নামায পড়ে।
রোযা ফরয প্রসঙ্গে আল্লাহপাক বলেন,‘তোমাদের প্রতি রোযা ফরয করা হয়েছে যেমন করা
হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পার’। আল্লাহতা’য়ালার পক্ষ
থেকে যত শরীয়ত আসছে সকল শরীয়তেই রোযা ফরয ছিল। উদ্দেশ্য একটাই-মানুষের মধ্যে
তাকওয়ার গুণ সৃষ্টি করা। তাকওয়া অর্জনের ক্ষেত্রে রোযা অনন্য, রোযার কোন বিকল্প নেই।
ইসলামের প্রতিটি অনুশাসন পালনে কিছু লৌকিকতা-প্রদর্শনী আছে; কিন্তু রোযা তা থেকে সম্পূর্ণ
মুক্ত। যেমন, নামায আদায়ের ক্ষেত্রে সকলের সাথে মিলে মসজিদে আদায় করতে হয়, হজ্ব সকলের
সাথে দীর্ঘপথ পাড়িয়ে দিয়ে আদায় করতে হয় এবং যাকাতের ক্ষেত্রে অন্তত গ্রহীতা জানতে পারে।
কিন্তু রোযার খবর আল্লাহপাক ছাড়া আর কেউ রাখে না। সকলের সঙ্গে সেহরী খেয়ে সারাদিন
পানাহার বন্ধ রাখা কেবল আল্লাহপাকের ভয়েই সম্ভব। প্রচন্ড গরমে পিপাসায় ছটফট করে, ক্ষুধার
জ্বালায় অস্থির হয়ে পড়ে, কিন্তু লোকচক্ষুর অগোচরে কোন রোযাদার কিছুই গ্রহণ করে না। করে না,
শুধু এই কারণে যে মহান আল্লাহ আ’লিমুল গায়িব-গোপন ও প্রকাশ্য সবই তাঁর কাছে সমান-কোন
কিছুই তাঁর থেকে আড়াল করা যায় না। শুধু এই বিশ্বাসই ইফতার সামনে নিয়ে বারবার ঘড়ি দেখে
কিন্তু কোন কিছু মুখে তুলে দেয় না। এখন প্রশ্ন? নির্জনে রোযাদার কিছু খেলে যে আল্লাহ দেখেন
সেই আল্লাহই আবার লোকের অগোচরে ওজনে কম দিলে, ভেজাল দিলে, ধোঁকা-প্রতারণার আশ্রয়
নিলে, ঘুষের আদান-প্রদান করলে দেখবেন না কেন? রোযা কয়েক ঘন্টা বা ২/১ দিন নয়, টানা
ত্রিশটা দিন মুসলমানদেকে এই প্রশিক্ষণই দেয় যে, তোমাদের কোন কাজ-কর্মই আল্লাহ থেকে
গোপন নয়; তাই সর্বাবস্থায় তোমরা আল্লাহকেই ভয় কর এবং রোয়ার দিনে কেবল আল্লাহপাকের
নির্দেশে যেমন অনেক বৈধ কাজ থেকে দূরে থাক (যেহেতু সে সময় তিনি তা তোমাদের জন্য নিষেধ
করেছেন) তাই সর্বাবস্থায় আল্লাহর নাফরমানি থেকে দূরে থাক। আর এই দূরে থাকার নামই
তাকওয়া এবং এই তাকওয়া সৃষ্টিই রোযার উদ্দেশ্য। দুর্ভাগ্য মুসলমানদের-যুগ যুগ ধরে উদ্দেশ্য
বিবর্জিতভাবেই তারা রোযা পালন করে আসছে। এই রোযায় তাদের আচরণ ও চরিত্রে কোন
পরিবর্তন আসছেনা। এ প্রসঙ্গে আল্লাহর রসুল (সাঃ) বলেন, ‘এমন অনেক রোযাদার আছেন ক্ষুতপিপাসায়
কষ্ট পাওয়া ছাড়া তাদের ভাগ্যে আর কিছইু জোটে না’। ‘রোযা রেখে যে মিথ্যা ও অশ্লীল
কথা-বার্তা পরিহার করতে পারলো না, তার রোযা রাখায় আল্লাহর কোনই প্রয়োজন নেই’। হাদীসে
বলা হয়েছে রোযা অবস্থায় কেহ যদি তার সাথে ঝগড়া করতে চায় তাহলে সে বলবে ‘ভাই, আমি
রোযাদার’। এই দীর্ঘ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তার মধ্যে সকল ময়লা আবর্জনা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নিখাত
খাঁটি বানানোই রোযার উদ্দেশ্য। আর এরূপ পরিশুদ্ধ রোযাদারের জন্যই বলা হয়েছে ‘জান্নাতে
একটি স্পেশাল দরজা দিয়ে সে প্রবেশ করবে। হাশরের ময়দানে সবাই যখন পেরেশোনির মধ্যে
থাকবে তখন দেখা যাবে রোযাদার আরশের ছায়ার নিচে খানাপিনায় ব্যস্ত। যারা ঈমান ও
এহতেছাবের সাথে রোযা রাখবে আল্লাহ তার অতীতের সকল গুনাহ মাফ করে দিবেন’। এ সবই
রোযাদারের জন্য খোশখবরী। দীর্ঘ এক মাস রোযা রাখার মাধ্যমে রোযাদারের মধ্যে এমন গুণ সৃষ্টি
হয় যাতে বাকী এগারোটা মাস সে সর্বপ্রকার আল্লাহর নাফরমানি অর্থাৎ সকল পাপাচার থেকে
নিজেকে মুক্ত রাখতে পারেন। মুসলমানদেরকে অবশ্যই রোযার উদ্দেশ্যকে স্মরণে রেখে রোযা
আদায় করতে হবে। তাহলেই কেবল ব্যক্তি পরিশুদ্ধির সাথে সাথে সমাজও পরিশুদ্ধ হয়ে উঠবে।
সমাজ থেকে দুর্নীতি দূর করতে হলে ব্যাপকভাবে মানুষের মধ্যে রোযার শিক্ষা তুলে ধরতে হবে।
কিন্তু দুর্ভাগ্য-যাঁরা এই কাজটি করবে তাঁরা আজ নানাভাবে বাধাপ্রাপ্ত ও নিঃগৃহিত। সমাজে
অপরাধপ্রবণ লোকের সংখ্যা খুবই স্বল্প। অধিকাংশ মানুষকে কুরআন-হাদীসের মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ করতে
পারলে তাদের মধ্যে সৎ গুণাবলীর প্রসার ঘটবে এবং আখিরাতের জবাবদিহির অনুভূতি জাগ্রত
করতে পারলে অবশ্যই তাদের মধ্যে অসৎপ্রবণতা দূর হয়ে যাবে। এজন্য মূল ভূমিকা পালন করতে
হবে সরকারকেই। মানুষ মূলত শাসকদেরকেই অনুসরণ করে থাকে। সরকারের দায়িত্ব ভালো
কাজের প্রচার ও প্রতিষ্ঠা এবং মন্দ কাজের প্রতিরোধ।
আল্লাহপাক মানুষকে পরিশুদ্ধ করার জন্য মটিভিশন বা উদ্বুদ্ধকরণের নানা পন্থা অবলম্বন
করেছেন। মানুষকে সৎ পথে ফিরে আসার জন্য বারবার আহবান জানিয়েছেন। মানুষের দ্বারা ভুল
হবে না বা মানুষ কখনই কোন অন্যায় করবে না বা অন্যায় করলেই মানুষকে তার শাস্তি ভোগ
করতেই হবে- ইসলাম এ মত পোষণ করে না। আল্লাহপাক বারবার তাকে তাঁর পথে ফিরে আসার
জন্য বলেছেন। অন্যায় করার পর কেহ যদি তা স্বীকার করে আল্লাহর নিকট তাওবা করে এবং
সেই অপরাধের পুনরাবৃত্তি না করে তাহলে আল্লাহ গফুরুর রহীম। সৃষ্টির প্রথম মানুষ দিয়েই তিনি
তা দেখিয়ে দিয়েছেন-হযরত আদম (আঃ) ও ইবলিস উভয়ই আল্লাহর নাফরমানি করেছিলেন। কিন্তু
দুইয়ের পার্থক্য হলো-আদম (আঃ) তাৎক্ষণিক ভুল স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন কিন্তু ইবলিস
দম্ভ ও অহংকার প্রকাশ করলো। প্রতিদান হিসাবে আল্লাহপাকও তাৎক্ষণিক (আদম আঃ)-কে ক্ষমা
করে দিলেন এবং শুধু ক্ষমাই নয় নবুয়তি দিয়ে তাঁকে সম্মানিত করলেন আর ইবলিসের উপর লানত
বর্ষণ করলেন। এই রমযান মাস আমাদের গুনাহ মাফের এক অপূর্ব সুযোগ নিয়ে হাজির হয়েছে।
হাদীসের ভাষাটা বড়ই আশাব্যঞ্জক-‘যারা ঈমান ও এহতেছাবের সাথে রোযা রাখবে আল্লাহ তাদের
অতীতের সকল গুনাহ মাফ করে দিবেন।’ আর একটি বর্ণনা এভাবে-রসুল (সাঃ) মিম্বরে
আরোহনকালে বলেন, ‘এইমাত্র জিবরিল (আঃ) আমাকে বলে গেলেন, যে ব্যক্তি রমযান মাস পেল
অথচ নিজের গুনাহ মাফ করে নিতে পারলো না সে যেন ধ্বংস হয়, আমি বললাম-আমীন’। এতে
স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে কুরআনের বরকতে আল্লাহপাক এ মাসটাকে তাঁর বান্দাদের ফিরে আসার এক
সুযোগ হিসাবে রেখে দিযেছেন। কিছু নিদর্শন তো এমনিতেই লক্ষ্য করা যায়-মসজিদগুলো
মুসল্লিতে পূর্ণ হয়ে যায়, রাজনীতিবিদরা তাদের কর্মসূচি স্থগিত রাখে এবং সর্বত্র একটি পবিত্র
পরিবেশ কিছুটা হলেও লক্ষ্য করা যায়। মনে হয় বড় শয়তানটাকে শৃঙ্খলিত করার ফলেই এতটুকু
সম্ভব হয়েছে। কিন্তু শয়তানের যারা মুরিদ অর্থাৎ মানব শয়তানগুলোকে শৃঙ্খলিত করার দায়িত্ব ছিল
আল্লাহর প্রতিনিধিদের-তাদের দায়িত্ব অবহেলার কারণেই রমযানের পুরা বরকত থেকে আমরা
বঞ্চিত হচ্ছি।
মুসলমানরা ইসলামের অনুশাসনসমূহ উদ্দেশ্যবিবর্জিতভাবে বছরের পর বছর পালন করে
যাচ্ছে। সকল কাজে উদ্দেশ্যই হ’ল মুখ্য। একজন ছাত্র লেখাপড়া করে পরীক্ষা দেয়-উদ্দেশ্য একটি
ভালো ফলাফল লাভ করা; একজন ডাক্তার রোগীর চিকিৎসা করে-উদ্দেশ্য তাকে সুস্থ করে তোলা,
ঠিক তেমনি রোযা ফরয করার উদ্দেশ্য হলো মানুষের মধ্যে তাকওয়ার গুণ সৃষ্টি করা। একজন
তাকওয়াবান ব্যক্তি কোন অবস্থাতেই আল্লাহর নিষিদ্ধ কাজ করতে পারে না; এমনকি সন্দেহজনক
কাজ থেকেও সে বিরত থাকে। আমরা যে সমস্ত কাজকে দুর্নীতি বলে থাকি ইসলামের পরিভাষায় এ
সবই হারাম। সব অবৈধ কাজই মানুষ লোকচক্ষুর আড়ালে করে থাকে; কিন্তু রোযাদার ঠিকই জানে
মানুষকে আড়াল করতে পারলেও আল্লাহর চোখকে কখনই ফাঁকি দেয়া সম্ভব নয়। একটানা ত্রিশ
দিন একজন রোযাদার সে প্রশিক্ষণই লাভ করে থাকে। তাই রোয়ার শিক্ষার মাধ্যমেই একজন ব্যক্তি
ও তার সাথে সমাজকে দুর্নীতিমুক্ত করা সম্ভব হতে পারে।
আমরা একটু আলোচনা করে দেখতে পারি সমাজে যে সব কাজ দুর্নীতি হিসেবে চিহ্নিত সে
সব সম্পর্কে ইসলামে দৃষ্টিভঙ্গি কি? যেমন অফিসে সেবা পেতে হলে ঘুষ দিতে হয় এবং এর প্রসার
সর্বব্যাপি। ঘুষ সম্পর্কে আল্লাহর রসুল (সাঃ) বলেন,‘ঘুষের দাতা ও গ্রহীতা উভয়ই দোযখী।’
বিষয়টি শর্তহীন। নিতান্ত দায়ে ঠেকে যদি কেউ দিয়ে থাকে তার বিষয়টি আল্লাহর হাতে। কিন্তু যে
ঘুষ গ্রহণ করে সে সন্দেহাতীতভাবে জাহান্নামী; আর কেউ যদি এটা বিশ্বাস না করে সে মূলত রসুল
(সাঃ)-কে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করলো (নাউজুবিল্লাহ)। সরকারি অফিস-আদালতে খেয়ানত এখন
একটি সাধারণ ব্যাপার হয়ে পড়েছে। অথচ আমানত সম্পর্কে হাদীসে বলা হয়েছে,‘ঐ ব্যক্তির ঈমান
নেই যার আমানতের ঠিক নেই।’ একজন মুসলমানের প্রথম পুঁজি হ’ল তার ঈমান। যার ঈমান নেই
তার নামায, রোযা, যাকাত ও হজ্ব সবই বৃথা। ব্যাংকে বহুল প্রচলিত শব্দ ঋণ খেলাফি অর্থাৎ
ওয়াদামত ঋণ ফেরৎ না দেয়া বা রাজনীতির অঙ্গনে দেয়া প্রতিশ্রতি, বন্ধু-বান্ধবদের নিকট থেকে
নেয়া ধার বা দোকান থেকে নেয়া ধার পরিশোধে গাফেলতি কোন মুসলমানের পক্ষে কি আদৌ
সম্ভব-য়েখানে হাদীসে বলা হয়েছে,‘ঐ ব্যক্তির ধর্ম নেই যার ওয়াদা-প্রতিশ্রুতির ঠিক নেই।’ এ
জাতীয় অধার্মিক লোকদের মৃত্যুর পর জানাজা পড়ার যৌক্তিকতাই বা কি? এমন কোন অপকর্ম নেই
যা আজ মুসলমানরা না করছে। ওজনে কম দেয়া, ভেজাল দেয়া, মিথ্যা কসম খাওয়া, ধোকাপ্রতারণা
করা, পরের সম্পদ হরণ করা, নারী নির্যাতন, যৌতুক দাবী, উত্তরাধিারকে ঠকানো, মিথ্যা
সাক্ষ্য প্রদান, গীবৎ, অপরকে কষ্ট দেয়া, খুন-রাহাজানি, চুরি-ডাকাতি সবই মুসলিম নামধারীদের
দ্বারা সংঘঠিত হচ্ছে। আসলে জাতিগতভাবে বেঈমান ও অধার্মিক হওয়ারই এ সব ফলশ্রুতি।
এদের সম্পর্কেই আল্লাহর রসুল (সাঃ) সাহাবীদেরকে বলেছিলেন, ‘আমি কি বলবো তোমাদের মধ্যে
সবচেয়ে দরিদ্র কে? সাহাবীরা বলেছিলেন যাদের টাকা-পয়সা নেই। রসুল (সাঃ) বলেছিলেন-না, ঐ
ব্যক্তি দরিদ্র যে নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাত আদায়ের সাথে সাথে মানুষকে গালি দিয়েছে, অপরের
হক নষ্ট করেছে ও মন্দ কাজ করেছে। কিয়ামতের দিন যাদের হক নষ্ট করেছে তাদের পাওনা তার
নেক আমল থেকে পরিশোধ করতে হবে এবং এটা সম্ভব না হলে তাদের গুনাহর বোঝা মাথায় করে
সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে’। এরই প্রতিধ্বনি করে আমাদের অন্যতম সাহিত্যিক ইসমাইল হোসেন
সিরাজী তাঁর সাহিত্যে লিখেছেন, ‘অতি নামাযী, কালামী, হাজী, দরবেশ পাপী গুনাহগার হতে
পারেন যদি তিনি করে থাকেন সামাজিক জীবনের দুশমনি’। তিনি আরো বলেছেন, ‘যে লোক বছর
বছর হাওয়ায় জাহাজে করে হজ্ব করে আসেন, তিনি যদি তাঁর কারখানার শ্রমিককে ন্যায্য
পারিশ্রমিক না দেন তাহলে তাঁর কবরে সোনার চাবি রেখে দিয়ে আসলেও সে চাবি দিয়ে
বেহেশতের কোন দরজাই খুলতে পারবে না’। রোযা যদি আমাদের মধ্যে আল্লাহর ভয় সৃষ্টি না করে
এবং আমাদের ব্যবহারিক জীবন যদি পরিশুদ্ধ না হয় তাহলে এ রোযা অর্থহীন উপবাস ছাড়া আর
কিছু হবে না।
নিজেদেরকে বেঈমান ও অধার্মিক প্রমাণ করা আমার উদ্দেশ্য নয়। সমাজের এই কদর্য চিত্র
দেখে আমার কষ্ট থেকে এই লেখা। আমি চাই সমগ্র মুসলিম জাতি তার অতীত ঐতিহ্য ধারণ করে
আবার বিশ্বকে শাসন করুক। এ জন্য প্রয়োজন চরিত্র। রসুল (সাঃ)-এর বাণী, ‘তোমাদের মধ্যে ঐ
ব্যক্তি উত্তম যে চরিত্রের দিক দিয়ে উত্তম’। আজ মুসলমানরা চরিত্রহারা। চরিত্রবান হিসাবে গড়ে
তোলার জন্যই আল্লাহপাক মুসলমানদের প্রতি নামায-রোযার মত আনুষ্ঠানিক ইবাদতসমূহ ফরয
করেছিলেন। আসুন, রমযানের এই সূচনালগ্নে আমরা আমাদের সকল অপকর্ম থেকে তাওবা করে
গোটা জীবনটাকে পরিশুদ্ধ করি এবং আল্লাহপাকের প্রতিশ্রুত জান্নাতের উপযুক্ত হই। আমীন।
Comments
Post a Comment