মানবপ্রকৃতিতে যা ভালো ও কল্যাণকর এমন সকল গুণের সমাবেশ ঘটেছিল আমাদের প্রিয়তম নবী মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের জীবনে। সততা, বিশ্বস্ততা, আমানতদারিতা, ওয়াদা-প্রতিশ্রুতি পালনসহ সকল সৎ গুণের অধিকারী ছিলেন তিনি। আল্লাহপাক নিজেই সাক্ষ্য দিয়েছেন, ‘নিসন্দেহে তুমি মহান চরিত্রের ওপর প্রতিষ্ঠিত’-সূরা ক্বালাম ৪। আরব জাহিলিয়াতে জন্ম ও বেড়ে ওঠার পরেও তিনি মিথ্যা, ধোঁকা-প্রতারণা, অশ্লীলতা-বেয়াপনা, আমানতে খেয়ানত, প্রতিশ্রুতিভঙ্গ, মানুষকে গালি দেয়া বা কষ্ট দেয়া এমন সব ধরনের অন্যায় ও নীতিবিবর্জিত কর্ম থেকে ছিলেন অনেক দূরে। তাইতো নবী হওয়ার পূর্ব থেকেই তিনি তাঁর জাতির কাছ থেকে পরিচিতি পেয়েছিলেন আল-আমিন ও আস-সাদিক হিসেবে।
তাঁর রেসালাতের দাবী অগ্রাহ্য হলে তাঁকে ধর্মত্যাগী, যাদুকর, কবি নানাভাবে উত্যক্ত ও নিপীড়ন-নির্যাতন করা হয়েছিল; কিন্তু তাঁর চরিত্রের ওপর আঘাত অর্থাৎ মিথ্যাবাদী, ধোঁকাবাজ, প্রতারক কেউ বলতে পারেনি। আরবের কঠিন পরিস্থিতিতে যেখানে সম্ভাবনার ক্ষীণ সম্ভাবনাও দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল না সেই সময়ে তাঁর দাওয়াতে সাড়া দেয়ার অন্যতম কারণ হলো কুরআনের অলৌকিক ক্ষমতা এবং কুরআনের ধারক নবী মুহাম্মদ (সা)-এর চরিত্রমাধুর্য।
নবী (সা)-এর দাওয়াতে সাড়াদানকারী নব্য মুসলমানদের তাওহিদ, রেসালাত ও আখিরাতে বিশ্বাসের পাশাপাশি নৈতিক চরিত্রে সেরা হিসেবে গড়ে ওঠার প্রশিক্ষণই আল্লাহর পক্ষ থেকে সে সময়ে দান করা হয়। মক্কীযুগের সূরাগুলো আলোচনা করলে সেটাই লক্ষ্য করা যাবে। বারবার আখিরাতের বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। আখিরাতে জবাবদিহিতা অর্থাৎ ভালো ও মন্দ কাজের বদলা দানের ওপর দৃঢ় বিশ্বাসই পারে মানুষকে সব ধরনের পাপাচার থেকে দূরে রেখে কল্যাণকর কাজে এগিয়ে যেতে।
আজ মুসলমানরা নামে তো মুসলমান। একটি বিরাট সংখ্যক প্রকাশ্য ঘোষণা না দিলেও ইসলাম থেকে বেরিয়ে সরাসরি ইসলামের বিরুদ্ধাচরণ করছে, আলেম-ওলামা এবং ইসলামপন্থী নেতৃবৃন্দ ও জনগোষ্ঠী তাদের কাছে অসহনীয়। আর একটি অংশ মুসলমান দাবী করে এবং তার সত্যতা প্রকাশ করে জুমা ও ঈদের নামাযে হাজিরা দিয়ে এবং কুরবানির সময়ে একটি বড় কুরবানি প্রদানের মাধ্যমে। অথচ তাদের আচার-আচরণ, লেন-দেন, ব্যবসা-বাণিজ্য-চাকুরি সকল ক্ষেত্রে ইসলামের সামান্য ছোঁয়াও দৃষ্টিগোচর হয় না। ফলে সীমাহীন জুলুম-নিপীড়ন-নির্যাতন, সুদ-ঘুষ, যিনা-ব্যাভিচার, মদ-জুয়ায় দেশটি ভরে ওঠেছে। আবার মসজিদ পাকাকরণ ও সৌন্দর্যবর্ধনের কাজও সমানতালে চলছে।
অথচ আল্লাহ ও তাঁর রসুল (সা) মুসলমানদের কিভাবে দেখতে চেয়েছেন, সেটা আমরা একটু আলোচনা করে দেখি। সূরা হুমাযায় আল্লাহপাক বলেছেন, ‘নিশ্চিত ধ্বংস তাদের জন্য যারা মানুষকে সামনা-সামনি গালাগাল ও পেছনে দোষ প্রচার করে’। পরবর্তিতে তাদের পরিণতি বলা হয়েছে, তাদেরকে হুতামায় নিক্ষেপ করা হবে। আর রসুল (সা) কী বলে গেলেন, ‘ঐ ব্যক্তি মুমিন নয়, মুমিন নয়, মুমিন নয় যার হাত ও মুখের অনিষ্ট থেকে অন্যরা নিরাপদ নয়’। একটি বিশ্বাসী জনপদে গুম-খুন, জুলুম-নির্যাতন কী স্বাভাবিক হতে পারে? বিদায় হজ্বের ভাষণে তিনি তাঁর উম্মতদের সতর্ক করে বলে গেলেন, তোমাদের জীবন-সম্পদ ও সম্মান পবিত্র। কোনোভাবেই তা ক্ষুণ্ণ করা যাবে না। আমাদের মনে রাখতে হবে, জালেমের জন্য জান্নাতে কোন ঠাঁই নেই, জ্বলন্ত আগুনই তার ঠিকানা। তার নামায-রোযা-হজ্ব সবই পন্ডশ্রম। বরং রসুল (সা) এ সব লোককে সবচেয়ে দরিদ্র বলে আখ্যায়িত করে বলেছেন, জালেমের সকল নেক আমলের বিনিময় মজলুমকে দেয়ার পরও শোধ হবে না এবং মজলুমের গুনাহ জালেমকে দিয়ে তাকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে জাহান্নামে ফেলে দেয়া হবে।
আমরা সূরা আসরে লক্ষ্য করি, কসম খাওয়ার মধ্য দিয়ে ধ্বংস ও বিপর্যয় থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহপাক ৪টি গুণের উল্লেখ করেছেন। ঈমানের সাথে নেক আমল, অন্যদের ভালোর দিকে আহবান ও ধৈর্যাবলম্বন করা। গুটি কয়েক আচার-অনুষ্ঠানের নাম নেক আমল নয়; বরং মানবপ্রকৃতি যেটা ভালো ও কল্যাণকর মনে করে এমন সবই নেক আমল। আল্লাহতায়ালা অন্যত্র বলেছেন, তোমাদের চেনা-জানা জিনিসকেই হালাল করা হয়েছে। আবার বলেছেন, হারাম সুনির্দিষ্ট, সকল পাক জিনিসই হালাল। বর্তমানে নেক আমল ও সদাচরণ থেকে আমরা অনেক দূরে। দুনিয়ার জীবনে সমৃদ্ধি ও উন্নয়ন নির্ভর করে এ সব নেক আমলের ওপর, যা আজ ইউরোপ-আমেরিকার অমুসলিমরা আয়ত্ত করে মুসলিম বিশ্বের ওপর কর্তৃত্ব করছে। নির্বাচনের মতো একটি মৌলিক বিষয়ও আজ প্রশ্নবিদ্ধ। দ্বীনের আংশিক মানার ফলে আল্লাহর প্রতিশ্রুত জিল্লতি আজ আমাদের ঘাড়ে চেপে বসে বসেছে, আর আখিরাতে রয়েছে ভয়াবহ শাস্তি।
রসুল (সা) তাঁর নিজের জীবন এবং কথা, কাজ ও অনুমোদনের মাধ্যমে সদাচরণের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে আমাদের সামনে রয়েছেন। তাঁর দুধমা, স্ত্রী, মেয়ে, আত্মীয়-স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব, ধনী-দরিদ্র, শত্রু, অমুসলিম সবার সাথে তাঁর আচরণ ছিল দয়ার্দ। আল্লাহ নিজেই প্রশংসা করেছেন, ‘তোমাদের কাছে তোমাদের মধ্য থেকে এক রসুল এসেছে, তোমাদের কোনোরকম কষ্টভোগ তার ওপর দুঃসহ, সে তোমাদের একান্ত কল্যাণকামী, ঈমানদারদের প্রতি সে হচ্ছে স্নেহপরায়ণ, পরম দয়ালু’-সূরা তাওবা ১২৮। আল্লাহপাক তাঁকে রহমাতুল্লিল আলামিন বলেছেন। তিনি সৃষ্টিজগতের জন্য রহমত। আমরা কি শুধু দরদ পড়েই ক্ষান্ত হবো; না, তাঁর অনুসারী হিসেবে মানুষসহ আল্লাহর সকল সৃষ্টির প্রতি হবো কল্যাণকামী। রসুল (সা) তো অপ্রয়োজনে গাছের একটি পাতা ছিঁড়তেও নিষেধ করেছেন। কষ্ট হবে বিধায় ভোঁতা অস্ত্র দিয়ে পশু-পাখি জবেহ করতে নিষেধ করেছেন। এই যেখানে নবী (সা)-এর শিক্ষা, সেখানে আমাদের চেহারা কতো কদর্য!
রসুল (সা) তাঁর উম্মতদের সদাচরণের জোর তাগিদ দিয়েছেন এবং চরিত্রের সবচেয়ে বড় দিক হলো সদাচরণ। একজন সদাচারী ব্যক্তি তার কথা ও কাজ দ্বারা কখনই আর একজন ব্যক্তির কষ্টের কারণ হতে পারে না। রসুল (সা) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তিই উত্তম যে চরিত্রের দিক দিয়ে উত্তম’। সদাচরণ ও উত্তম চরিত্রের ব্যাপারে রসুল (সা)-এর অসংখ্য বাণী রয়েছে। ‘যারা বড়দের সম্মান ও ছোটদের স্নেহ করে না তারা আমাদের সমাজভুক্ত নয়’। অর্থাৎ মুসলমান নয়। ‘প্রসন্নচিত্তে একবার মা’র দিকে দৃষ্টিদান কবুল হজে¦র সমান’। ‘পৃথিবীর সম্পদ, শ্রেষ্ঠতম সম্পদ ধার্মিকা নারী’। ‘আখিরাতে স্ত্রীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হবে’। ‘জমিনে যারা আছে তাদের সাথে সদাচরণ করো, তাহলে আসমানে যিনি আছেন তিনিও তোমাদের সাথে সদাচরণ করবেন’। অধীনস্থদের সম্পর্কে বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তিই উত্তম যে তার অধীনস্থদের কাছে উত্তম’। ‘দৈনিক সত্তর বার হলেও তাদের অপরাধ ক্ষমা করে দাও’। পথের ভিক্ষুক থেকে শুরু করে সকল মানুষ সদাচরণের দাবীদার এবং কারো সঙ্গে অসদাচরণ অর্থই হলো তার সাথে জুলুম করা এবং জালেম আল্লাহর কাছে সবচেয়ে ঘৃণিত।
আজ মুসলমান সদাচরণ ভুলে গেছে। উদারতা, সহনশীলতা, ক্ষমা এ সব মহৎ গুণাবলী থেকে অনেক দূরে। হিংসা-বিদ্বেষ-প্রতিশোধপরায়ণাতায় ইসলামপূর্ব জাহিলিয়াত ছাড়িয়ে গেছে। মিথ্যাবলা, মিথ্যাসাক্ষ্যদানে তার বিবেক একটুও কাঁপে না। সে ভুলে গেছে তার রসুল (সা)-এর বাণী, ‘আমার উম্মত সব পারে, কিন্তু মিথ্যা বলতে পারে না’। ‘মিথ্যা সকল পাপের মা’। ‘মিথ্যা সাক্ষ্যদান শিরকের সমতুল্য বড় গুনাহ’। আদালতে অনর্গল মিথ্যা বলা, মিথ্যাবলায় প্রশিক্ষণ দেয়া উকিল ও এর সাথে সংশ্লিষ্টরা ধ্বংস হোক। এ সব মুশরিকদের জন্য আল্লাহর শাস্তি ছাড়া ভিন্ন কিছু কি আশা করা যায়?
ক্ষমা করার মতো ঔদার্য তো নেই-ই, বরং মিথ্যা কথা রটনায় আজ এই মুসলিম নামধারীরা আরব মুশরিকদেরকেও হার মানিয়েছে। কতো নিরীহ-নিরপরাধ মানুষের প্রতি অপবাদ দিয়ে তাদের সম্মান ক্ষুণ্ণ করা হচ্ছে এবং জাতির কাছে হেয় করা হচ্ছে, তার হিসেব নেই। অথচ সে জানে ‘গীবৎ করা মরা ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সমতুল্য’ (কুরআন); সে আরো জানে ‘গীবৎ যিনা অপেক্ষাও জঘন্য’। সে এও জানে, ‘যে তার ভাইয়ের দোষ গোপন করবে আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার দোষ গোপন করবেন’ এবং ‘যে তার ভাইকে ক্ষমা করবে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন’। এ সব জানায় তার কিছু আসে যায় না, সে এখন বিশ্বাসবিবর্জিত এক নিরেট নাস্তিক। ইসলাম ও নবী (সা) উদারতা শিখেছেন, চর্চা করেছেন এবং শত্রুকে নাগালের মধ্যে পেয়ে ক্ষমা করেছেন, আর আজ তার অনুসারীরা হিংস্র জানোয়ারের মতো ভিন্ন মতাবলম্বীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ আজ আর জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র নয়; মারামারি, হানাহানি ও লুটপাটের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। আশার দিক, বেশির ভাগ শিক্ষার্থী এই অন্যায়-অপকর্মে জড়িত নয়, তারা ঘৃণা করে এবং পরিবর্তন কামনা করে; কিন্তু নেতৃত্বের আসনে নেই। সর্বত্রই আজ অসৎ নেতৃত্ব, ঘোর অন্ধকার। রাত গভীর হলে প্রভাত নিকটবর্তী হয়ে পড়ে। এ জাতির ভাগ্যেও তেমন প্রভাত নেমে আসতে পারে। আমরা সেই প্রভাতের প্রতীক্ষায়। ০৪.১০.২০১৯
Comments
Post a Comment