Skip to main content

সূরা ৮৫ আল বুরূজ মক্কায় অবতীর্ণ আয়াত ২২


বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম
১.         শপথ বিশালাকায় গম্বুজবিশিষ্ট আকাশের,
২.         শপথ সে দিনের যার আগমনের ওয়াদা করা হয়েছে,
৩.         শপথ প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীর, শপথ সেই ভয়াবহ দৃশ্যের এবং যা কিছু তখন পরিদৃষ্ট হয়েছে তার;
৪.         (মুমিনদের জন্য খোঁড়া) গর্তের মালিকদের ওপর অভিসম্পাত-
৫.         আগুনের কুন্ডলি-যা জালানি দ্বারা পরিপূর্ণ ছিল,
৬.         (অভিসম্পাত) যখন তারা তার পাশে বসা ছিল,
৭.         এ লোকেরা মুমিনদের সাথে যা করছিলো তারা তা প্রত্যক্ষ করছিলো;
৮.         তারা এ ঈমানদারদের কাছ থেকে এ ছাড়া অন্য কোন কারণে প্রতিশোধ গ্রহণ করেনি যে, তারা এক পরাক্রমশালী ও প্রশংসিত আল্লাহর ওপর ঈমান এনেছিল,
৯.         (ঈমান এনেছিল এমন এক সত্তার ওপর) যার জন্যে (নিবেদিত) আসমানসমূহ ও যমীনের যাবতীয় সার্বভৌমত্ত্ব; আর আল্লাহতায়ালা (তাদের) সব কয়টি কাজের ওপরই সাক্ষী;
১০.       যারা ঈমানদের নর ও নারীর ওপর অত্যাচার করেছে অতঃপর তাওবা করেনি, তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের আযাব, আছে ভস্ম হওয়ার শাস্তি;
১১.        (অপরদিকে) নিশ্চয়ই যারা ঈমান এনেছে ও ভালো কাজ করেছে, তাদের  জন্যে রয়েছে এমন জান্নাত যার নীচ দিয়ে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত, সেটাই সবচেয়ে বড় সাফল্য;
১২.       নিশ্চয়ই তোমার রবের পাকড়াও হবে ভীষণ শক্ত;
১৩.       নিশ্চয়ই তিনি প্রথম সৃষ্টি করেছেন, তিনি আবারও সৃষ্টি করবেন,
১৪.       তিনি পরম ক্ষমাশীল, তাঁর সৃষ্টিকে অত্যন্ত ভালোবাসেন,
১৫.       তিনি সম্মানিত আরশের একচ্ছত্র অধিপতি,
১৬.       তিনি যা চান তাই করেন;
১৭.       তোমার কাছে কি কতিপয় বিদ্রোহী সেনাদলের কথা পৌঁছেছে?
১৮.       ফেরাউন ও সামুদ বাহিনীর কথা!
১৯.       এরা কোন দিনই সত্য বিশ্বাস করেনি, বরং তারা মিথ্যা সাব্যস্তকরণে লেগেই ছিল,
২০.       অথচ আল্লাহতায়ালা এদের সবদিক থেকে ঘিরে রেখেছেন;
২১.       কুরআন উন্নত ও মহামর্যাদাসম্পন্ন (একটি গ্রন্থ);
২২.       এক মহাফলকে সংরক্ষিত আছে।
নামকরণ : প্রথম বাক্যের বুরূজ শব্দকে নাম হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে।
নাযিলের সময়কাল : রসূল (সা.)-এর মক্কী জীবনের এমন এক সময় এ সূরাটি অবতীর্ণ হয় যখন কাফির-মুশরিকদের অত্যাচার-নির্যাতনে মুসলমানদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল।
বিষয়বস্তু : এক কঠিন মুহূর্তে এই সূরাটির মাধ্যমে একদিকে মুশরিকদেরকে সতর্ক করা হয়েছে, অন্যদিকে ঈমানদারদেরকে শান্তনা দেয়া হয়েছে এই বলে যে, অতীতে ঈমান আনার কারণে অনেক লোককে সীমাহীন জুলুম-নির্যাতন এমন কি আগুনের গর্তে পুড়ে মরতে হয়েছে। ঈমানদারদেরকে সেই আগুনের গর্তে নিক্ষেপ করে কাফিররা চতুর্দিকে দাঁড়িয়ে দেখেছে ও উল্লাস করেছে। ঈমানদাররা মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছে; কিন্তু ঈমান ত্যাগ করেনি। ইসলামের দুশমনরা দলবলে যত বড় শক্তিশালীই হোক না কেন, আল্লাহর শক্তির মোকাবেলায় তারা খুবই নগন্য যেমন ফেরাইন ও সামুদের দলবল তাদের কোন কাজে আসেনি। ঈমানদারদের সাথে দুশমনির বিনিময়ে জাহান্নামই হবে তাদের বদলা।
ব্যাখ্যা : স্রেফ ঈমান আনার কারণে কাফিররা আগুনের গর্ত তৈরী করে মুমিনদেরকে তাতে নিক্ষেপ করে গর্তের চতুর্দিকে দাঁড়িয়ে জ্বলে-পুড়ে মরার বিভৎস দৃশ্য দেখেছে। সেই কাফিরদের কঠিন পরিণতির কথা বলতে গিয়ে আল্লাহপাক কসম খেয়েছেন গম্বুজবিশিষ্ট আসমানের, কিয়ামতের এবং কিয়ামতের ভয়াবহ লোমহর্ষক দৃশ্যাবলীর। এই সব ঈমানদাররা ছিলেন সম্পূর্ণ নির্দোষ ও সৎ প্রকৃতির। আল্লাহর ভাষায় পরাক্রমশালী আল্লাহর ওপর ঈমান আনায়নই ছিল তাদের একমাত্র অপরাধ। রসূল (সা.) ও তাঁর সাহাবীদের সাথে আরবের কাফির-মুশরিকদের দুশমনীর মূলেও একই কারণ। আজও  দেশে দেশে হকপন্থীদের ওপর বাতিলের জুলুম-নির্যাতনের পেছনে ইসলাম ছাড়া অন্য কোন কারণ নেই। অনুপম চরিত্র ও মধুর আচরণের কারণে রসূল (সা.) তাঁর জাতির কাছ থেকে উপাধী পেয়েছিলেন আল-আমিন ও আস-সাদিক। অথচ তিনিই যখন তাঁর জাতির কাছে দ্বীনের দাওয়াত পেশ করেন তখন তিনি আর তাদের বন্ধু নন; এক ভয়ঙ্কর শত্রুতে পরিণত হন। এমতাবস্থায় জালেমদের ভয়াবহ পরিণতির (জাহান্নামই হল ঠিকানা) কথা এখানে উল্লেখ করার সাথে সাথে আল্লাহ বলেছেন কোন কিছুই তাঁর অগোচরে নয়। তিনি সবকিছু দেখছেন এবং তাঁর পাকড়া বড় শক্ত। তাঁকে বাহিনীর ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। ফেরাউন ও সামুদের বাহিনী ও লোকবল তাদেরকে আল্লাহর পাকড়াও থেকে রক্ষা করেনি। কাফিরের পরিণতি বলতে আল্লাহ সাধারণত আখিরাতে শাস্তির কথাই বলেছেন। আখিরাতের তুলনায় দুনিয়ার জীবনটা খুবই ক্ষণস্থায়ী। তাই আখিরাতে য়ে ক্ষতিগ্রস্ত হলো সেই সত্যিকার অর্থে ব্যর্থ হলো। অন্যত্র আল্লাহ বলেন- বেশ, তাহলে এদের ওপর আযাব নাযিল করার জন্য অস্থির হয়ো না, আমি এদের দিন গণনা করছি। সে দিনটি অচিরেই আসবে যেদিন মুত্তাকীদেরকে মেহমান হিসেবে রহমানের সামনে পেশ করা হবে এবং অপরাধীদেরকে পিপাসার্ত পশুর মত জাহান্নামের দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হবে (সূরা মরিয়ম)। এত কিছু বলার পরও মানুষের প্রতি আল্লাহর ভালোবাসার কোন তুলনা নেই। ঈমানদারদের প্রতি জুলুম-নির্যাতন করার পরও কেউ যদি তাওবা করে অর্থাৎ অন্যায়-অপকর্ম থেকে নিজেকে ফিরিয়ে নেয় তাহলে আল্লাহ তার প্রতিও ক্ষমাশীল।
ইসলামের দুশমনদের জুলুম-নির্যাতনের মোকাবেলায় যারা ঈমানের পথে অবিচল থাকে তাদের জন্যই সুসংবাদ। এখানে বলা হয়েছে যারা ঈমান এনেছে ও নেক আমল করেছে, তাদের  জন্যে রয়েছে এমন জান্নাত যার নীচ দিয়ে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত, সেটাই সবচেয়ে বড় সাফল্য। ঈমান ও নেক আমল যেন সমার্থক। যার মধ্যে ঈমান রয়েছে তার আচার-আচরণ, চাল-চলন ও কাজে-কর্মে তার প্রতিফলন অবশ্যম্ভাবী। নেক আমলের পুঁজি নিয়ে শয়তানের মোকাবেলারও তাগিদ দেয়া হয়েছে এবং আল্লাহপাক তার পাক কালামে ঈমানদার ও কাফিরকে পরস্পরের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। তাঁর ভাষায়-যারা ঈমানের পথ গ্রহণ করে তারা আল্লাহর পথে লড়াই করে ও যারা কুফুরির পথ অবলম্বন করে তারা লড়াই করে তাগুতের (খোদাদ্রোহীতা) পথে (সূরা নেছা)। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আল্লাহ তায়ালা মুমিনদেরকে নির্যাতিত হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। আসলে এ দুনিয়াটা হলো একটি পরীক্ষাগার। মুমিন ও কাফির উভয়কেই আল্লাহ যাচাই-বাছাই করছেন। মুমিনের পরীক্ষা হলো, সে কতখানি ধৈর্য অবলম্বন করে ও তাঁর রবের প্রতি নির্ভরতা রাখে। আর কাফির কতখানি সীমালঙ্ঘন করে সেটাও আল্লাহ তায়ালা দেখে নিতে চান। অন্যায়-জুলুমের প্রতিবাদ-প্রতিরোধ ঈমানেরই পরিচায়ক। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই আল্লাহ ও তাঁর রসূল (সা.)-এর পথচলাকে সম্মুখে রাখতে হবে। সন্ত্রাস ও জুলুম-নির্যাতনের মোকাবেলায় আল্লাহপাক তাঁর প্রিয় বান্দাহদেরকে পরম ধৈর্য অবলম্বনের জন্য বারবার তাগিদ দিয়েছেন এবং জালিমের বিরুদ্ধে বোঝাপড়ার ব্যাপারটা তাঁর ওপর সোপর্দ করে ইতিবাচক কাজ (অর্থাৎ সর্বাবস্থায় নেক আমলের সাথে দাওয়াতে দ্বীনের কাজ) করে যাওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছেন। এমন হতে পারলে জনসম্পৃক্ততাও বাড়বে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন- নিঃসন্দেহে যারা ঈমান এনেছে ও সৎকাজ করেছে শীঘ্রই রহমান তাদের জন্য মানুষের অন্তরে ভালোবাসা সৃষ্টি করে দেবেন (সূরা মরিয়ম)।
আল্লাহপাক কাফিরদেরকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন যে, তিনি যেমন প্রথমবার সৃষ্টি করেছেন, তেমনি আবারও সৃষ্টি করতে সক্ষম; তিনি বিশ্ব সাম্রারাজ্যের মালিক যা ইচ্ছা তাই করতে সক্ষম। আখিরাতে শাস্তিদানের সাথে সাথে দুনিয়াতেও শাস্তিদানে তিনি সক্ষম এবং ইতোপূর্বে দিয়েছেনও। ঈমানদারদের সাথে যারা শত্রুতা করছে তাদের শায়েস্তা করার দায়িত্ব তাঁর; তিনি তাদেরকে চতুর্দিক থেকে ঘৈরাও করে আছেন এবং তাঁর নাগালের বাইরে যাওয়ার সাধ্য কারো নেই। কাফিরদের বড় শত্রুতা কুরআনের সাথে; কুরআনের বাণী যারা প্রচার করে তাদেরকে তারা সহ্য করতে পারে না। হাজারো প্রচেষ্টা চালিয়েও এই কুরআনের কোন ক্ষতি করার ক্ষমতা তাদের নেই। এই কুরআন সুরক্ষিত ফলকে লিপিবদ্ধ রয়েছে, কোন রদবদল বা ক্ষতি সাধন বা এর প্রচার চিরতরে বন্ধ করার ক্ষমতা কারো নেই। আল্লাহ নিজেই এর সংরক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন।
শিক্ষা : এই সূরাটি মুমিনদের জন্য বড় জানার ও বোঝার। নির্ভেজাল ঈমানের দাবীদারদের প্রতি জুলুম-নির্যাতন খুবই স্বাভাবিক এবং অতীত থেকেই তা ঘটে আসছে। শত অপবাদ, জুলুম-নির্যাতন উপেক্ষা করে যারা টিকে থাকবে তারাই সফলকাম। মুমিনরা আল্লাহ তায়ালার বড়ই প্রিয়ভাজন এবং তিনি তাদের অন্তরে প্রশান্তি দান করেন। যারা মুমিনদের সাথে শত্রুতা পোষণ করে তারা মূলত আল্লাহর সাথেই শত্রুতা করে থাকে এবং শাস্তিদানে আল্লাহপাকই যথেষ্ট। তাই মুমিনদের উচিৎ আল্লাহর ওপর নির্ভরতা পোষণ করা।



Comments