দুশো
বছর বৃটিশ শাসনের অধীন থেকে ১৯৪৭ সালে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাসমূহ নিয়ে পাকিস্তান
এবং হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাসমূহ নিয়ে ভারত প্রতিষ্ঠা লাভের পরও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানীদের
ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয় না। দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব, ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকুরী সকল ক্ষেত্রে
তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানীদের প্রাধান্যের কারণে এতদঞ্চলের মানুষ নানাভাবে শোষিত ও
বঞ্চিত হতে থাকে। গণতান্ত্রিক শাসনের অনুপস্থিতিতে দেশের শাসনক্ষমতায় সংখ্যাগরিষ্ঠ
হওয়ার পরও বাঙালীদের অংশগ্রহণ ছিল খুবই নগণ্য। প্রতিবেশী ভারত বিশাল দেশ এবং নানা সমস্যা
সত্ত্বেও গণতন্ত্র সমুন্নত থাকার কারণে বড় ধরনের সংকটের সম্মুখীন তাদেরকে হতে হয়নি।
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে দেশে সেনাশাসন এবং গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে স্বৈরশাসন দেশকে
গভীর সংকটে নিমজ্জিত করে। শুরুতেই রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর সাথে
বাঙালীদের বিরোধ বাধে। ১৯৫২ সালে রক্তদানের মধ্য দিয়ে এ দেশের মানুষ অধিকার সচেতন হন
এবং সে সময় হতে উভয় অঞ্চলের মানুষের মধ্যে বিদ্বেষ ক্রমাগত বাড়তে থাকে। তৎকালীন পূর্ব
পাকিস্তান বৃটিশ আমল থেকেই অনগ্রসর ছিল। আইউব শাসনামলে কোন উন্নয়ন হয়নি এ কথা আমরা
বলি না। শিক্ষা-দীক্ষা, রাস্তাঘাট, অফিস-আদালত, শিল্প-কারখানায় বেশ উন্নয়ন হলেও দুই
অঞ্চলের মধ্যে উন্নয়নগত পার্থক্য ছিল ব্যাপক। পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের বড়
উৎস ছিল পাট। এই রপ্তানী আয় ও ঋণের সিংহভাগ ব্যয় হত পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলে। এ ছাড়া
জাতীয় আয়ের বড় অংশ ব্যয় হত সেনাবাহিনীর পেছনে, আর সেখানে বাঙালীদের অংশ ছিল খুবই সীমিত। আঞ্চলিক বৈষম্য ছাড়াও মানুষে মানুষেও ছিল সীমাহীন
বৈষম্য। সৃষ্টি হয় ২২ পরিবারের, যাদের সবাই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের। গণতন্ত্রকে স্বাভাবিক
পন্থায় কাজ করতে না দিয়ে নানা মোড়কে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার প্রয়াস শুরু থেকেই লক্ষ্য
করা যায়। মানুষ শিক্ষিত নয়, ভালো-মন্দ উপলব্ধি করার মত জ্ঞান নেই, এ সব নানা অজুহাতে
শাসক নির্বাচনের ক্ষমতা জনগণ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে মৌলিক গণতন্ত্র নামে নতুন এক পন্থা উদ্ভাবন
করা হয় এবং তখন থেকেই রাজনৈতিক অঙ্গনে সূচনা হয় ঘুষ-দুর্নীতির। শোষণ-বঞ্চণা ও জেল-জুলুমের
প্রতিবাদে বাঙালীরা ফুঁসে উঠতে থাকে। যে মুহূর্তে প্রেসিডেন্ট আইউব খান সাড়ম্বরে উন্নয়নের
দশক উদযাপন করছিলেন সে মুহূর্তে দেশে সৃষ্টি হয় তীব্র গণ আন্দোলন এবং তাতে আইউব খানের
পতন হয়। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর দল বাঙালীদের প্রতি জুলুম-নির্যাতন ও শোষণ-বঞ্চণার বিরুদ্ধে
এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সব সময় সোচ্চার ছিলেন। তাই সামরিক শাসক
ইয়াহিয়া ১৯৭০ সালে দেশে সাধারণ নির্বাচন দিলে আওয়ামী লীগ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে
নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। শাসনক্ষমতা পশ্চিমাদের হাতছাড়া হওয়াটা তারা কোনভাবে
মেনে নিতে পারছিলো না। তাই ভুট্টোর যোগসাজশে বঙ্গবন্ধুর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে নানা
টালবাহানার এক পর্যায়ে তারা নিরস্ত্র বাঙালীদের শক্তিপ্রয়োগে দমনের সিদ্ধান্ত নেয় এবং
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালো রাত্রিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঙালীদের ওপর। ইতোমধ্যে বাঙালীরা বঙ্গবন্ধু
শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীনতা প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ হয়ে পড়ে এবং সে সময়ে বঙ্গবন্ধু
উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেন- `এবারের
সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।‘ মুক্তিকামী মানুষ দীর্ঘ নয় মাস প্রাণান্তকর লড়াই-সংগ্রামের
মধ্য দিয়ে ১৬ ডিসেম্বর ছিনিয়ে আনে স্বাধীনতার লালসূর্য। অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন সার্বভৌম
বাংলাদেশের এবং বিশ্বদরবারে নিজেদেরকে বাংলাদেশী হিসেবে গর্বভরে পরিচয় দানের সুযোগ
পায়। মহান মুক্তিযুদ্ধে যারা আত্মদান করেছেন আমরা তাঁদেরকে গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ ও
মাগফেরাত কামনা করি।
মহান
মুক্তিযুদ্ধের পশ্চাতে যে প্রেরণা কাজ করেছে তা হলো শোষণ ও বঞ্চণামুক্ত একটি গণতান্ত্রিক
রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েমের স্বপ্ন। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল প্রবাসী সরকার গঠন হয় এবং সেই
প্রবাসী সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মরহুম তাজউদ্দীন আহমদ ১১ এপ্রিল জনগণের উদ্দেশ্যে
বেতার ভাষণে বলেন-‘বাংলাদেশের
নিরন্ন দুঃখী মানুষের জন্য রচিত হোক এক নতুন পৃথিবী, যেখানে মানুষ মানুষকে শোষণ করবে
না। আমাদের প্রতিজ্ঞা হোক ক্ষুধা, রোগ, বেকারত্ব আর অজ্ঞানতার অভিশাপ থেকে মুক্তি।
এই পবিত্র দায়িত্বে নিয়োজিত হোক সাড়ে সাত কোটি বীর বাঙালী ভাইবোনের সম্মিলিত মনোবল
ও অসীম শক্তি। যাঁরা আজ রক্ত দিয়ে উর্বর করছে বাংলাদেশের মাটি, যেখানে উৎকর্ষিত হচ্ছে
স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন মানুষ, তাঁদের রক্ত আর ঘামে ভেজা মাটি থেকে গড়ে উঠুক নতুন
গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা; গণমানুষের কল্যাণে সাম্য আর সুবিচারের ভিত্তিপ্রস্তরে লেখা
হোক ‘জয় বাংলা’, ‘জয়
স্বাধীন বাংলাদেশ’
(বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র, ৩য় খন্ড পৃষ্ঠা ১২)। বঙ্গবন্ধু মানুষকে বৈষম্যের
কথা শুনিয়েছিলেন, শুনিয়েছিলেন শোষণ-বঞ্চণার কথা, শুনিয়েছিলেন অপশাসন ও গণতন্ত্রহীনতার
কথা এবং মানুষ বিশ্বাস করে সবকিছু উজাড় করে দিয়ে সমর্থন ও মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।
কিন্তু অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা ও কুরবানীর বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা এক শ্রেণির লুটেরাদের
কবলে পড়ে সকল প্রত্যাশা ধ্বংস করে দেয়। মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী জাতির মধ্যে যে ঐক্য
গড়ে উঠেছিল সেটা ধরে রেখে একটি সমৃদ্ধ জাতি গড়ে তোলার সুযোগ বঙ্গবন্ধু পেয়েছিলেন এবং
সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার মাধ্যমে তিনি স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ ভুলে গিয়ে দেশ গড়ার কাজে
সবাইকে এগিয়ে আসার উদাত্ত আহবানও জানিয়েছিলেন। হত্যা-ধর্ষণ-অগ্নিসংযোগের মত মারাত্মক
অপরাধে মুষ্টিমেয় কিছু লোক ছাড়া রাজনৈতিক কারণে আটক সবাইকে তিনি মুক্ত করে দেন। দক্ষিণ
আফ্রিকার মহান নেতা নেলসন মেন্ডেলা তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠতম ও বড় সময় শ্বেতাঙ্গদের কারাগারে
কাটিয়েছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতার পরে তিনি পক্ষ-বিপক্ষ বা শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ সব ভুলে
গিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকান হিসেবে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে সমৃদ্ধ দেশ গঠনে সক্ষম হন। তাই তিনি
শুধু তাদের মহান নেতা নন, তিনি বিশ্বনেতাও। কিন্তু বাংলাদেশে যে প্রত্যাশা নিয়ে মানুষ
মুক্তিযুদ্ধে শরীক হয়েছিল তা না পেয়ে চরমভাবে হতাশ হয়ে পড়ে এবং এই সুযোগে একশ্রেণির
মতলববাজ রাজনীতিক সর্বহারার রাজ কায়েমের নামে দেশে চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। দেশে
বিশৃঙ্খল ও অরাজক পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য বঙ্গবন্ধু বাধ্য হন রক্ষীবাহিনী গঠনে। পাহাড়সম
জনপ্রিয় বঙ্গবন্ধু দ্রুতই অপ্রিয় হয়ে উঠেন এবং গণতন্ত্রের লড়াকু সৈনিক বঙ্গবন্ধু শেষে
গণতন্ত্রের পথ পরিহার করে গঠন করেন একদলীয় বাকশাল, যা ছিল জনগণের আশা-আকাঙ্খার সম্পূর্ণ
বিপরিত। যার ফলশ্রুতিতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে তাঁকে জীবন দিতে হয়। পাকিস্তানী
শাসকগোষ্ঠী যাঁকে হত্যা করতে সাহস পায়নি, স্বাধীনতার মহানায়ক ও দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে
তাঁর দেশেই জীবন দিতে হলো। জাতির জন্য এটা এক বড় দুর্ভাগ্যই বলতে হয়। তাঁর মৃত্যুর
পর রাজনীতির মঞ্চে আবির্ভাব ঘটে জিয়াউর রহমানের। দেশের স্বার্থে অতীতের তিক্ততা ভুলে
সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াস তাঁর মাঝে ছিল। তিনি বঙ্গবন্ধু কন্যাকে দেশে আসার এবং
বহুদলীয় গণতন্ত্র চর্চার সুযোগ করে দেন। কিন্তু ঘাতকের বুলেট থেকে তিনিও রেহাই পাননি।
আমাদের দেশে মূল সমস্যা হলো রাজনীতিক। গণতন্ত্রে যে উদারতা, সহনশীলতা, দলমত নির্বিশেষে
সবাইকে নিয়ে চলার মানসিকতা তা আমাদের দেশের রাজনীতিতে নেই। রাজনীতিক অঙ্গনে সুস্পষ্ট
বিভাজন রয়েছে, ফলে আমাদের রাজনীতিতে আস্থাহীনতা প্রবল। সুষ্ঠু নির্বাচন গণতন্ত্রের
পূর্ব শর্ত, আস্থাহীনতার কারণে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন অসম্ভব হয়ে পড়েছে
এবং একপর্যায়ে কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা আমাদের সংবিধানে যুক্ত হয়। কয়েকটি নির্বাচন
কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে হলেও বর্তমানে তা বিলুপ্ত হওয়ায় রাজনীতিতে এক অচলাবস্থা সৃষ্টি
হয়েছে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রত্যাশা ছিল নির্ভেজাল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা।
গণতন্ত্রের অভাবে দেশে সুশাসন, ন্যায়বিচার প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে; পক্ষান্তরে দেখা দিয়েছে
জুলুম-নির্যাতন ও গুম-খুনের মত ঘটনা। উন্নয়নের গণতন্ত্র নয়, মানুষ চায় নির্ভেজাল গণতন্ত্র
যেখানে স্বাধীনভাবে তার মতামত প্রকাশ ও চলাফেরা করতে পারে। তাইতো পোলান্ডের শ্রমিক
নেতা ও পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট লেস ওয়ালেসাকে বলতে শোনা যায়-‘উদায়ান্ত পরিশ্রম করে এক বাটি ঝোলেও আমি তৃপ্ত হব,
যদি আমাকে কথা বলার অধিকার দেয়া হয়।’
রাজনীতিক বৈষম্যের পাশাপাশি অর্থনৈতিক বৈষম্যও প্রবল হয়েছে। স্বাধীনতা পূর্ব আমলে ২২টি
পরিবার ছিল এখন হয়তো তা ২২ হাজারে দাঁড়িয়েছে। আগে শিল্পকারখানা করে শ্রমশোষণ ও কাঁচামালের
দাম কম দিয়ে তারা মুনাফার অংক স্ফীত করেছে; অবশ্য পাশাপাশি কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হয়েছে।
আর এখন শেয়ারবাজার, ডেসটিনি, হলমার্ক, সোনালী ব্যাংক ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক কেলেঙ্কারী
ও ঋণখেলাফের মাধ্যমে জনগণের অর্থ হাতিয়ে নিয়ে বিদেশে পাচার করছে। আগে শিল্পপতিরা কর্মসংস্থান
সৃষ্টির পাশাপাশি স্বল্প হলেও শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ নানা সেবাখাতে কিছুটা ব্যয় করেছে;
কিন্তু বর্তমানে শিল্পপতিরা শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতকে ব্যবসা হিসেবে গ্রহণ করেছে এবং
মানুষের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে শোষণ করছে। আর অফিস-আদালতে ঘুষ-দুর্নীতি তো রয়েছেই। মুক্তিযুদ্ধে
রাজনীতিক স্বাধীনতার পাশাপশি অর্থনৈতিক মুক্তিও অন্যতম প্রত্যাশা ছিল। আগে চাকুরী ও
ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল পশ্চিমাদের হাতে, এখন রয়েছে দলীয় ও দুর্নীতিবাজদের হাতে। বাঙালী
জাতির বড় অর্জন ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা। কিন্তু এর পেছনে জনগণের প্রত্যাশা
ছিল আকাশচুম্বি। তারা শোষণহীন, নিপীড়নমুক্ত ও নিরাপদ একটি সমাজ প্রত্যাশা করেছিল; কিন্তু
না প্রাপ্তির কারণে তাদের মধ্যে হতাশা কাজ করছে। তারপরও বলবো, সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ;
রাজনীতিকদের সদিচ্ছা ও পারস্পরিক আস্থা-সহনশীলতা এবং পেছনে না তাকিয়ে সামনে চলার দৃঢ়
প্রত্যয় এ জাতির প্রত্যাশা পূরণে সহায়ক হতে পারে। মহান বিজয় দিবসের প্রাক্কালে আল্লাহতায়ালার
দরবারে একটি সমৃদ্ধ ও নিরাপদ বাংলাদেশ আমরা কামনা করি। ১৬/১২/২০১৭
Comments
Post a Comment