Skip to main content

কুরআনের পাঠ (সূরা হামীম আস সাজদা ২৬-৩২)


বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম
‘এসব কাফেরেরা বলে, এ কুরআন তোমরা কখনো শুনবে না। আর যখন তা শুনানো হবে তখন হট্টগোল বাধিয়ে দেবে। হয়তো এভাবে তোমরা বিজয়ী হবে। আমি এসব কাফেরদের কঠিন শাস্তির মজা চাখাবো এবং যে জঘন্যতম তৎপরতা তারা চালিয়ে যাচ্ছে তার পুরো বদলা তাদের দেবো। প্রতিদানে আল্লাহর দুশমনরা যা লাভ করবে তা হচ্ছে দোযখ। সেখানেই হবে তাদের চিরদিনের বাসস্থান। তারা আমার আয়াতসমূহ অস্বীকার করতো। এটা তাদের সেই অপরাধের শাস্তি। সেখানে এসব কাফেররা বলবে, ‘হে আমাদের রব, সেই সব জিন ও মানুষকে আমাদের দেখিয়ে দাও যারা আমাদের পথভ্রষ্ট করেছিলো। আমরা তাদের পদদলিত করবো, যাতে তারা লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়।
যারা ঘোষণা করেছে, আল্লাহ আমাদের রব, অত:পর তার ওপরে দৃঢ় ও স্থির থেকেছে নিশ্চিত তাদের কাছে ফেরেশ্তা আসে এবং তাদের বলে, ভীত হয়ো না, দুঃখ করো না এবং সেই জান্নাতের সুসংবাদ শুনে খুশি হও, তোমাদেরকে যার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। আমরা এই দুনিয়ার জীবনেও তোমাদের বন্ধু এবং আখেরাতেও। সেখানে তোমরা যা চাবে তাই পাবে। আর যে জিনিসেরই আকাঙ্খা করবে তাই লাভ করবে। এটা সেই মহান সত্তার পক্ষ থেকে মেহমানদারীর আয়োজন। তিনি ক্ষমাশীল ও দয়াবান’। সূরা হা-মীম আস সাজদাহ ২৬-৩২
রসূল (সা.)-এর মক্কী জীবনের শেষের দিকে অবতীর্ণ এই সূরাটি। সে সময়ে রসূল (সা.)-এর দাওয়াতী কাজে প্রচন্ড বিরোধীতা শুরু হয়ে গিয়েছিল। একদিকে ছিল আরবের কাফের-মুশরিকদের অবস্থান, অপরদিকে ছিল জুলুম-নির্যাতনের শিকার স্বল্পসংখ্যক মুসলমান। দুই পক্ষের আচরণ যেমন ছিল ভিন্নতর, তেমনি তাদের পরিণতিও অবশ্যম্ভাবী ভিন্নতরই হবে। কাফের ও মুসলমানের মধ্যে পার্থক্য নাম ও বংশে নয়; বরং পার্থক্য হলো তাদের ঈমান ও আমলে। তাই কারো নাম রবার্টসন বা তারা সিং-এ জন্য সে কাফের বা কারো জন্ম মুসলিম বংশে না হয়ে অন্য বংশে তাই সে কাফের-ইসলাম তা স্বীকার করে না। নবীর ঘরে জন্মগ্রহণ করেও নূহ (আ.)-এর ছেলে মুসলমান হতে পারেনি। আবার কাফেরের ঘরে জন্মগ্রহণ করে হযরত ইব্রাহিম (আ.) শুধু মুসলমানই নন, বরং মুসলিম জাতির পিতা হয়েছেন। এখানে কাফেরদের একটি আচরণ তুলে ধরে বলা হয়েছে যে, ওরা কুরআনের বিরোধী এবং একই সাথে এ কথাও বলা যায়, যারা কুরআনের বিরোধী তারাই কাফের।
রসূল (সা.) সুদীর্ঘ ৪০টা বছর তাঁর সমাজে বসবাস করেছেন এবং অসাধারণ চরিত্র ও ব্যক্তিত্বের কারণে তিনি সকলের আস্থা কুড়িয়েছেন। বাণীবাহক ফেরেশ্তার মাধ্যমে তাঁর ওপর কুরআন অবতীর্ণ হলে তিনি প্রথমে গোপনে এবং পরে আল্লাহর নির্দেশক্রমে প্রকাশ্যে প্রচার শুরু করলে আরবের প্রভাবশালী নেতৃবৃন্দ ও তাদের প্ররোচনায় সাধারণ মানুষ বিরোধীতা শুরু করে। কুরআন আল্লাহর কালাম। এর অসাধারণ ভাষাশৈলী ও বক্তব্য সহজেই মানুষকে আকৃষ্ট করতো। তারপরও যদি তা নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর পক্ষ থেকে তেলাওয়াত করা হত। রসূল (সা.)-এর কাজ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন-‘তিনি তোমাদের মধ্য থেকে একজনকে রসূল হিসেবে প্রেরণ করেছেন, তাঁর কাজ হলো মানুষকে আল্লাহর আয়াত পড়ে শোনানো ও মানুষকে পরিশুদ্ধ (তাজকিয়া) করা এবং কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেয়া’। তাই নবী (সা.)-এর দাওয়াতের হাতিয়ার ছিল আল কুরআন। যা কিছুই তাঁর প্রতি অবতীর্ণ হত তাই তিনি মানুষের কাছে পাঠ করে শোনাতেন। এতে কাফেরেরা প্রমাদ গুণে। তাই তারা নবী (সা.)-এর দাওয়াতের বিরোধীতার ক্ষেত্রে বেছে নেয় এক নিকৃষ্ট পন্থা-তারা নিজেরা মুহাম্মদ (সা.)-এর বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণার ঝড় তুলেছিল, নতুন কেউ আসলে তার কাছে নবী (সা.) সম্পর্কে বিষোদগার করতো। কিন্তু নবী (সা.)-কে কথা বলার সুযোগ দিতে তারা রাজি ছিল না। তিনি কথা বলতেন কুরআন দিয়ে। কাফেরেরা সিদ্ধান্ত নেয় যে, তারা নিজেরা কুরআন শুনবে না এবং কেউ যাতে না শুনতে পায় সে জন্য কুরআন শোনানোর কাজে হৈ-হুল্লোড় করবে, তালি বাজাবে, শীষ দিবে, হাঙ্গামা বাধাবে। শয়তান তাদের দোসর। শয়তান এ কাজগুলোকে তাদের সামনে শোভন করে তুলে ধরে এবং বলে যে এমন আচরণের মধ্যেই তোমাদের কল্যাণ। সকল যুগে সকল সময়ে ইসলামের দুশমনরা একই পন্থা অবলম্বন করেছে। এখন আর মসজিদে কুরআনের দরস বা তাফসিরের কথা শোনা যায় না। কুরআনের নেতা-কর্মীরা আজ নানাবিধ জুলুম-নির্যাতনের শিকার। কুরআনের সাথে এমন আচরণকারীদেরকে আল্লাহ তাঁর নিজের দুশমন বলে আখ্যায়িত করে তাদের কঠোর শাস্তির হুশিয়ারী এবং শাস্তি হিসেবে চিরস্থায়ী দোযখের কথা বলেছেন। সাধারণ মানুষ নেতা-নেত্রীদেরকে অনুসরণ করে এবং সমাজে প্রভাবশালীদের প্ররোচনায় সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে ও তাদের সাথে মিলে কুরআনের কর্মীদের প্রতি অত্যাচার-নির্যাতন করে থাকে। আখেরাতের সেই কঠিন দিনে প্রভাবশালীদের পরিণতি হবে বড় ভয়াবহ। সেদিন তাদের অনুসারীরা চাইবে যাদের কারণে আজ তারা আযাবের সম্মুখিন তাদের সেই সব নেতা-নেত্রীদেরকে লাঞ্ছিত ও অপমানিত করতে। অবশ্যই নেতা-নেত্রীরা তাদের নিজেদের গুনাহ ও অনুসারীদের গুনাহ একত্র করেই শাস্তি ভোগ করবে।
সীমাহীন জুলুম-নির্যাতন সহ্য করেও যারা দ্বীনের পথে অবিচল থাকে তাদেরকে এখানে শান্তনা দেয়া হয়েছে। আল্লাহকে রব মেনে দৃঢ় থাকার অর্থ হলো সর্বাবস্থায় আল্লাহর আনুগত্যে অবিচল থাকা। অর্থাৎ বিপদ-মুছবিতে ঘাবড়ে যেয়ে দ্বীন থেকে ফিরে না যাওয়া। এদের জন্যই আল্লাহতায়ালা ফেরেশ্তা নাজিল করেন, যাদের কাজ হলো মু’মিনদেরকে বিপদ-মুছিবতে অবিচল রাখা। চর্মচোখে ফেরেশ্তাদের দেখা না গেলেও অন্তরে অনুভব করা যায়, যার প্রেক্ষিতে মু’মিনরা শক্তি-সাহস অনুভব করেন এবং ফাঁসির মঞ্চেও সত্যের জয়গান গেয়ে থাকেন। এই সমস্ত মু’মিনদের জন্য জান্নাতের সুস্পষ্ট ঘোষণা রয়েছে। আল্লাহর এ ওয়াদায় খুশি থাকার জন্য মু’মিনদেরকে আহবান জানানো হয়েছে। আখেরাতে কাউকে পুরস্কার বা শাস্তি আল্লাহর ইলমের ভিত্তিতে নয় বরং মানুষের আমলের ভিত্তিতেই প্রদান করা হবে। তাই আল্লাহ মাঝে-মধ্যেই বলেছেন-আল্লাহকে অবশ্যই দেখে নিতে হবে ঈমানের দাবীতে কে সত্যবাদী আর কে মিথ্যাবাদী। এখানে মু’মিন ও কাফের উভয়কেই আল্লাহ পরীক্ষায় ফেলেছেন। কাফেরের পরীক্ষা হচ্ছে সে কতখানি সীমালঙ্ঘন করতে পারে, আর মু’মিনের পরীক্ষা সে কতখানি ধৈর্য অবলম্বন করতে পারে। দুনিয়ার জীবন খুবই ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু আখেরাতের জীবনটা সীমাহীন। দু’টি জীবন গুরুত্বপূর্ণ হলেও মু’মিন প্রাধান্য দেয় আখেরাতের জীবনকে। আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে মু’মিন দুনিয়ার জীবনটাকে খুব সহজেই অবজ্ঞা করতে পারে। যেমন ফেরাউনের যাদুকররা বলেছিল-‘তুমি বড়জোর আমাদের দুনিয়ার জীবনটাকে বরবাদ করে দিতে পারো’। আর আল্লাহর বক্তব্যও তাই-‘আল্লাহর পথে সংগ্রাম করার যোগ্য কেবল তারাই যারা পরকালের বিনিময়ে দুনিয়ার জীবন বিক্রয় করে দিতে পারে’। তাই মানবীয় কৌশল যত নিখুঁতই হোক আল্লাহর পথে চলতে গেলে পরীক্ষা আসবেই। আল্লাহর কাছে আমাদের একান্ত প্রার্থনা-যে পরীক্ষায় টিকে থাকা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয় এমন পরীক্ষায় যেন তিনি আমাদেরকে না ফেলেন। আমিন। ১৩/১১/২০১৫






Comments