বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম
যারা নিজেদের ওপর জুলুম করছিল, ফেরেশতারা তাদের জান কবজ করার সময় জিজ্ঞেস করলো : তোমরা কী অবস্থায় ছিলে? তারা জবাব দিল, আমরা পৃথিবীতে ছিলাম দুর্বল ও অক্ষম। ফেরেশতারা বললো : আল্লাহর জমিন কি প্রশস্ত ছিল না? তোমরা কি সেখান থেকে হিজরত করে অন্যস্থানে যেতে পারতে না? জাহান্নাম এসব লোকের আবাস স্থিরীকৃত হয়েছে এবং আবাস হিসেবে তা বড়ই খারাপ জায়গা। তবে যেসব পুরুষ, নারী ও শিশু যথার্থই অসহায় এবং তারা বের হবার কোনো পথ-উপায় খুঁজে পায় না, আল্লাহ তাদের মাফ করে দেবেন এবং আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল ও করুণাময়। যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে হিজরত করবে, সে পৃথিবীতে আশ্রয় লাভের জন্য অনেক জায়গা এবং সময় অতিবাহিত করার জন্য বিরাট অবকাশ পাবে। আর যে ব্যক্তি নিজের গৃহ থেকে আল্লাহ ও রসুলের দিকে হিজরত করার জন্য বের হবে, তারপর পথেই তার মৃত্যু হবে, তার প্রতিদান দেয়া আল্লাহর জন্য ওয়াজিব হয়ে গেছে। আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল ও করুণাময়’- সুরা আন নিসা ৯৭-১০০।
নামকরণ : মাদানি সুরা। বিভিন্ন বিষয়াবলি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তাই বিষয়ভিত্তিক কোনো শিরোনাম নির্ধারণ না করে চিহ্নস্বরূপ সুরা নিসা নামকরণ করা হয়েছে অর্থাৎ যে সুরায় নিসা বা রমণি শব্দটি উল্লেখ রয়েছে।
নাজিলের সময়কাল : বিভিন্ন সময়ে ঘটনার প্রেক্ষিতে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে নির্দেশনা হিসেবে নাজিল হয়েছে। তৃতীয় হিজরির শেষ থেকে চতুর্থ হিজরির শেষ বা পঞ্চম হিজরির প্রথম দিকে অবতীর্ণ হয়।
বিষয়বস্তু : কোনো একক বিষয় নয় বরং মদিনায় ইসলাম একটি রাষ্ট্রীয় দীন হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে এবং সেসময়ে শরিয়তের বিধি-বিধান প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে নাজিল করা হয়। ওহুদ যুদ্ধে ৭০জন সাহাবি শাহাদত বরণ করে। অনেকে বিধবা হন আবার অনেকে ইয়াতিম হন। এই সুরায় উত্তরাধিকার আইন, ইয়াতিমদের লালন-পালন, যুদ্ধের ময়দানে ভয়কালীন নামাজ, পানির অভাবে তায়াম্মুমের বিধান ইত্যাদি শরিয়তের হুকুম উল্লেখ করা হয়েছে। কাফের, মুশরিক, আহলে কিতাব ও মুনাফিকদের সাথে আচরণ কেমন হবে তাও বলা হয়েছে। মদিনায় ইসলাম প্রতিষ্ঠা লাভের ফলে মুসলমানদের এক নিরাপদ আবাস গড়ে উঠে এবং মক্কা ও আশেপাশে ইসলামে দিক্ষীত সবাইকে হিজরত করে মদিনায় চলে আসার জন্য নির্দেশ প্রদান করা হয়। ৯৭ থেকে ১০০ পর্যন্ত তাদের প্রসঙ্গেই বলা হয়েছে।
ব্যাখ্যা : ইসলামের মৌল দাবি মানুষ কেবল আল্লাহকেই ইলাহ মানবে এবং আল্লাহরই আনুগত্য করবে। আল্লাহ ছাড়া সকল আনুগত্য অস্বীকার করবে। এটি কেবল তখনই সম্ভব যখন জমিনে আল্লাহর দীন অর্থাৎ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত থাকে। মুসলমান মাত্রই আল্লাহতে পরিপূর্ণ সমর্পিত। আল্লাহর হুকুমের বাইরে একটি মুহূর্তও চলার সুযোগ নেই। কালিমা তাইয়্যেবার অর্থ আনিই বুদুল্লাহ ওয়াজতানিবুত তাগুত অর্থাৎ ‘তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো এবং তাগুতকে অস্বীকার করো’। ইসলামকে খণ্ড-বিখণ্ড করার কোনো সুযোগ নেই। অর্থাৎ ধর্মীয় বিধি-বিধান পালনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত নিষ্ঠাবান, এখানে ফরজ-ওয়াজিব, সুন্নত-মুস্তাহাব সবই মেনে চলে কিন্তু মানুষের জীবনের সামগ্রিক দিক ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি, খেত-খামার, উত্তরাধিকার আইন, রাজনীতি, অর্থনীতি সকল ক্ষেত্রে তাগুতকে মেনে চলে- এই যদি কারো জীবনের অবস্থা হয় তাহলে সে আর মুসলিম থাকে না, হয়ে পড়ে কাট্টা মুনাফিক। আল্লাহপাক সকল নবি-রসুলকে একই দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন- দীন কায়েম করো এবং এ ব্যাপারে মতপার্থক্য করো না (আশ শূরা ১৩)। দীন কায়েমের প্রশ্নে সকল নবি-রসুলের সাথে সমসাময়িক রাজা- বাদশাহ ও তাদের সাঙ্গপাঙ্গদের (তাগুত) সাথে চরম বিরোধ এবং নবি-রসুলগণ নানাভাবে জুলুম-নির্যাতন সহ্য করেছেন এবং অনেককে শহিদ করা হয়েছে। এটিই ইতিহাস এবং এটি কুরআনেরই বর্ণনা। হক ও বাতিল চেনার মানদণ্ড এই দ্বন্দ্ব-সংগ্রাম। বাতিলের সহযোগী হয়ে দীনের খেদমত মূলত আজর ও আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই-এর সার্থক অনুসরণ।
রসুলুল্লাহ সা.-কে দীন কায়েমের দায়িত্ব দিয়েই মূলত পাঠানো হয়েছে (সুরা সফ, ফাতহা, তওবা)। দাওয়াতের সূচনায় তাঁকে বলা হয়েছে, তুমি তোমার রবের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করো (সুরা মুদ্দাস্সির)। সকল নবি-রসুলের দাওয়াত ছিল- বলো, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ এবং তাতেই তোমরা সফলকাম। সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি এবং আল-আমিন ও আস-সাদিক উপাধিপ্রাপ্ত ব্যক্তিটির মুখে কালিমা তাইয়্যেবার উচ্চারণ তাঁর আপন চাচাসহ আরবের কাফের-মুশরিকরা বরদাশত করতে পারেনি। দীর্ঘ তেরোটা বছর প্রাণান্ত প্রচেষ্টার পর আল্লাহপাকের সাহায্যে মদিনায় এক অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয় এবং আল্লাহর হুকুমে তিনি মদিনায় হিজরত করে এক ইসলামী রাষ্ট্র গঠন করেন। ফলে মানুষ একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর হুকুম মেনে চলার সুযোগ পায়। মুসলমান যেহেতু আল্লাহর হুকুম ছাড়া আর কারো হুকুম মানতে পারে না। তাই মক্কাসহ আশেপাশে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিল তাদের সবাইকে হিজরত করে মদিনায় (দারুল ইসলাম) চলে আসার জন্য নির্দেশ প্রদান করা হয়। এই নির্দেশ যারা অমান্য করে স্ব স্ব বাড়িঘরে অবস্থান করছিল তাদের কঠোর শাস্তির কথা এখানে বলা হয়েছে। আর শাস্তি হিসেবে জাহান্নাম নির্ধারিত করে রাখা হয়েছে। অবশ্য যারা নিরুপায় হয়ে অবস্থান করছিল তাদেরকে ক্ষমা করার কথাও বলা হয়েছে।
৯৭ থেকে ১০০ তিনটি আয়াত থেকে স্পষ্ট উপলব্ধি করা যায়, একজন মুসলমান কোনো অবস্থাতেই আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ইলাহ মেনে তার আনুগত্য করতে পারে না। দারুল ইসলাম কোনো দেশে হিজরত করতে হবে নয়তো নবি-রসুলগণ যেমন তাগুতি জীবনব্যবস্থার অধীনে বসবাস করে সেটা পরিবর্তনের মাধ্যমে আল্লাহর দীন কায়েম করার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চালিয়েছেন তেমনিভাবে দলবদ্ধ প্রচেষ্টা চালাতে হবে। একজন মুসলমান বনে-জঙ্গলে ঘাস-লতাপাতা খেয়ে জীবনধারণ করতে পারে কিন্তু একটা মুহূর্তও অনৈসলামিক জীবব্যবস্থার অধীনে সন্তুষ্ট জীবন যাপন করতে পারে না। আল্লাহপাকের ওয়াদা কেউ হিজরত করতে চাইলে তাঁর পক্ষ থেকে সহায়তা করা হবে কারণ তাঁর জমিন অনেক প্রশস্ত। এমতাবস্থায় ঘর থেকে বের হয়ে পড়লে পথে যদি কারো মৃত্যু হয় তাহলে তার প্রতিদান দেওয়া আল্লাহর জন্য ওয়াজিব হয়ে যায়। বর্তমান বিশ্বে যে রাষ্ট্রকাঠামো তাতে উত্তম হয় স্ব স্ব দেশে দীন কায়েমের লক্ষ্যে হেকমতের সাথে মানুষের কাছে দীনের দাওয়াত পৌঁছে দেওয়া এবং তাদেরকে আল কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে পরিশুদ্ধ করা। এই দায়িত্ব আন্তরিক ও দলবদ্ধভাবে পালন করলে ইনশা- আল্লাহ তারা জয়ী হবে। এটা আল্লাহপাকেরই ওয়াদা (সুরা নুর ৫৫)। আল্লাহ তায়ালা মুসলিম উম্মাহকে সঠিক উপলব্ধি দান করুন। ০৩.০৩.২০২৩
Comments
Post a Comment