বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম
হে নবি! প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিমত্তা এবং সদুপদেশ
সহকারে তোমার রবের পথের দিকে দাওয়াত দাও এবং লোকজনের সাথে বিতর্ক করো সর্বোত্তম পদ্ধতিতে।
তোমার রবই বেশি ভালো জানেন কে তাঁর পথচ্যুত হয়ে আছে এবং কে আছে সঠিক পথে। আর যদি তোমরা
প্রতিশোধ নাও, তাহলে ঠিক ততটুকু নাও যতটুকু তোমাদের ওপর বাড়াবাড়ি করা হয়েছে। কিন্তু
যদি তোমরা সবর করো তাহলে নিশ্চিতভাবেই এটা সবরকারীদের জন্য উত্তম। হে মুহাম্মদ! সবর
অবলম্বন করো। আর তোমার এ সবর আল্লাহরই সুযোগ দানের ফলমাত্র। এদের কার্যকলাপে দুঃখ করো
না এবং এদের চক্রান্তের কারণে মনঃক্ষুণ্ণ হয়ো না। আল্লাহ তাদের সাথে আছেন যারা তাকওয়া
অবলম্বন করে এবং যারা সৎকর্মপরয়ণ। সুরা আন নাহল ১২৫-১২৮।
নামকরণ : ৬৮ নং আয়াতের ‘আর দেখ, তোমার
রব মৌমাছিদেরকে একথা ওহির মাধ্যমে বলে দিয়েছেন’ বাক্যাংশ থেকে
নামকরণ করা হয়েছে ‘আন নাহল’। এটি কোনো শিরোনাম
নয়। পরিচিতির জন্য অন্যান্য সুরার মতই চিহ্নস্বরূপ রাখা হয়েছে।
নাজিলের সময়কাল : সুরায় উল্লিখিত বিভিন্ন
সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে বলা যায় সুরাটি মক্কায় শেষের দিকে নাজিল হয়েছে, যখন রসুলুল্লাহ
সা. ও তাঁর সাহাবিদের ওপর চরম দমন-পীড়ল চলছিল।
৪১ নং আয়াত (যারা জুলুম সহ্য করার পর আল্লাহর
খাতিরে হিজরত করেছে তাদেরকে আমি দুনিয়াতেই ভালো আবাস দিব এবং আখেরাতের পুরস্কার অনেক
বড়) সাক্ষ্য দেয় যে সুরাটি আবিসিনিয়ায় হিজরতের পর নাজিল হয়েছে।
১০৬ নং আয়াত সাক্ষ্য দেয় সেসময়ে চরম জুলুম-পীড়ন
চলছিল এবং বাধ্য করা হচ্ছিল কুফুরি বাক্য উচ্চারণ করতে (যে ব্যক্তি ইমান আনার পর কুফুরি
করে, তাকে যদি বাধ্য এবং তার অন্তর ইমানের ওপর নিশ্চিন্ত থাকে)।
সুরা নাহল ও সুরা আনআম দুটি সামান্য ব্যবধানে নাজিল হয়েছে। এই সুরার ১১৫
নং (আল্লাহ যা কিছু তোমাদের ওপর হারাম করেছেন তা হচ্ছে মৃতদেহ, রক্ত, শুকরের গোশত এবং
যে প্রাণীর ওপর আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নাম নেয়া হয়েছে) এমন একটি আয়াত যার বরাত দেয়া
হয়েছে সুরা আনআমের ১১৯ নং আয়াতে (যে জিনিসের ওপর আল্লাহর নাম নেয়া হয়েছে সেটি না খাওয়ার
তোমাদের কী কারণ থাকতে পারে? অথচ যেসব জিনিসের ব্যবহার আল্লাহ নিরূপায় অবস্থা ছাড়া
অন্য সব অবস্থায় হারাম করেছেন সেগুলোর বিশদ বিবরণও তিনি তোমাদের জানিয়ে দিয়েছেন)। এতে
বোঝা যায় সুরা নাহল সুরা আনআমের পূর্বে নাজিল হয়েছে।
বিষয়বস্তু : শিরককে বাতিল করে তাওহিদকে
প্রমাণ করা এবং মুহাম্মদ সা.-এর দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করার পরিণতি ও হকের পথে প্রতিবন্ধকতা
সৃষ্টি করার বিরুদ্ধে ভীতি প্রদর্শন করা এই সুরার মূল বিষয়বস্তু। সাথে সাথে নবি মুহাম্মদ
সা. ও তাঁর সঙ্গী-সাথীদের মনে সাহস সঞ্চার করা হয়েছে এবং জুলুম-পীড়নের মোকাবেলায় তাঁদের
করণীয় বলা হয়েছে।
ব্যাখ্যা : নবুয়ত লাভের পরপরই আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশিত
হয়ে (সুরা মুদ্দাস্সির) মুহাম্মদ সা. মানুষের কাছে দাওয়াত পৌঁছাতে থাকেন। প্রথমে গোপনে
এবং পরবর্তী সময়ে প্রকাশ্যে দাওয়াত প্রদান শুরু করেন। দাওয়াত দানের সাথে সাথে তাঁর
ও তাঁর সাথীদের ওপর জুলুম নির্যাতন চলতে থাকে। জুলুম-পীড়নের মাত্রা বাড়লেও কোনো একটা
মুহূর্তও দ্বীনের দাওয়াত দান বন্ধ ছিল না। ব্যাপক দাওয়াতের মাধ্যমেই কেবল দ্বীনের প্রসার
সম্ভব। সুরা আন নাহ্লে আল্লাহপাক তাঁর নবি সা.-কে দাওয়াতদানের কৌশল এবং বিরোধীতার মোকাবেলায়
করণীয় নির্দেশ করেছেন। এই উপদেশ কেয়ামত পর্যন্ত দ্বায়ী ইলাল্লাহ সকলের জন্য প্রযোজ্য।
দাওয়াত দানের ক্ষেত্রে দ্বায়ী ইলাল্লাহকে
প্রথমত প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিমত্তার (হেকমত) পরিচয় দিতে হবে। যার কাছে দাওয়াত পৌঁছাবে তার
জ্ঞান, যোগ্যতা, সময়, মানসিক অবস্থা ও পরিবেশ সবকিছু বিবেচনা করে দেখতে হবে, দাওয়াত
দান তার কাছে গ্রহণীয় হওয়ার মতো অবস্থায় রয়েছে কি না। দ্বিতীয়ত বলা হয়েছে, সদুপদেশ
সহকারে দাওয়াত দিতে। অর্থাৎ যাকে দাওয়াত দেয়া হচ্ছে সে যেন উপলব্ধি করে, দাওয়াত দানকারী
তার কল্যাণকামী। দ্বায়ীর চরিত্র, আচার-আচরণ, লেনদেনে সচ্ছতা থাকতে হবে। ইসলামের দিকে
মানুষকে ডাকার সাথে সে নিজে যেন ইসলামের অনুসারী হয়। নিজে একনিষ্ঠ অনুসারী না হলে সদুপদেশ
ক্রিয়া করে না। দাওয়াত দানকারীর ব্যক্তিচরিত্র দাওয়াতের ক্ষেত্রে খুব প্রভাব বিস্তার
করে।
দাওয়াত দানের ক্ষেত্রে বিতর্ক খুবই স্বাভাবিক।
সহজেই দাওয়াত কবুল করার ঘটনা খুবই বিরল। তাকে নানা ধরনের কূটতর্কের মুখোমুখি হতে হয়।
মুহাম্মদ সা. ছিলেন সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী ও এই পৃথিবীর বুকে সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ।
তিনি ছিলেন জাতির সর্বোচ্চ কল্যাণকামী এবং জাতির লোকেরা সেটি উপলব্ধিও করতো। তারপরও
তাঁর দাওয়াতের জবাবে তাঁকে অনেক তিক্ত কথা শুনতে হয়েছে। আল্লাহপাক তাঁকে বিতর্ক এড়িয়ে
চলতে বলেছেন এবং তিক্ত কথার জবাব তিক্তভাবে না দিয়ে অত্যন্ত দরদের সাথে দেয়ার জন্য
বলেছেন। বিতর্কে জয়ী হওয়ার প্রবণতা কখনো যেন দ্বায়ীর মধ্যে পেয়ে না বসে।
সাধারণভাবে সবার কাছে দাওয়াত পৌঁছাতে হবে।
দাওয়াত কার জন্য ফলপ্রসু হবে সে জ্ঞান কেবল আল্লাহর। অবশ্য আল্লাহ অন্যত্র বলেছেন,
যে অগ্রসর হয়ে আসবে তার প্রতি বেশি মনোযোগী হতে হবে (সুরা আবাসা)। আল্লাহর সকল বান্দা
তাঁর দ্বীনের দাওয়াত পাওয়ার হকদার। নারী-পুরুষ, ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, কাফের-মুশরিক
সবাইকে দরদের সাথে দাওয়াত দিতে হবে।
মক্কায় বড় কঠিন অবস্থায় এই সুরাটি নাজিল
হয়। অত্যাচার-নির্যাতনে টিকতে না পেরে অনেকে হাবশায় হিজরত করেছিলেন এবং যারা মক্কায়
অবস্থান করছিলেন তারা সীমাহীন জুলুম-নির্যাতনের সম্মুখীন হয়েছিলেন। এই প্রতিকূল অবস্থায়
অর্থাৎ জুলুমের শিকার মজলুমদের মাঝে বদলা গ্রহণের আকাক্সক্ষা জাগা খুবই স্বাভাবিক।
আর ঐ সময়ে আমীর হামজা ও ওমরের মতো কিছু বাহাদুর বীরযোদ্ধা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। এখানে
আল্লাহ তায়ালা জুলুমের প্রতিশোধ গ্রহণের সুযোগ দান করেছেন। কিন্তু প্রতিশোধ গ্রহণের
ক্ষেত্রে কোনোক্রমেই সীমালঙ্ঘন করা যাবে না। অর্থাৎ বদলা গ্রহণের ক্ষেত্রে একেবারে
মেপে মেপে নিতে হবে। থাপ্পড়ের পরিবর্তে লাঠির আঘাত বা একজনের পরিবর্তে দশজনকে হত্যা
বা কর্মীর হত্যার বদলে নেতাকে হত্যা বা হত্যার সাথে সাথে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া কখনই
করা যাবে না। এমন আচরণ সবই হবে বাড়াবড়ি এবং মজলুম নিজেই তখন জালেমে পরিণত হয়ে পড়বে।
আল্লাহপাক বদলা গ্রহণ পছন্দ করেন না। তিনি চান, এমন অবস্থায় তাঁর বান্দা সবর করুক এবং
তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, সবরকারীদের জন্য সেটি হবে উত্তম। কুরআন মজিদে অন্যত্র বলা হয়েছে
অন্যায়ের প্রতিবিধান সমপরিমাণ অন্যায়, কিন্তু কেউ যদি ক্ষমা করে দেয় ও সংশোধন করে নেয়
তার পুরস্কার আল্লাহর জিম্মায় (সুরা আস শূরা ৪০)।
অতীতের সকল নবি-রসুল থেকে শুরু করে মুহাম্মদ
সা. এবং বর্তমান পর্যন্ত দেখা যায়, যারা মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকে উন্নত চরিত্রের
অধিকারী হওয়া সত্তে¡ও তারা নানাভাবে নির্যাতিত হয় এবং ভবিষ্যতেও হবে। সমাজে হক ও বাতিলের
এই দ্বন্দ্ব চিরন্তন। এই দ্বন্দ্ব-সংগ্রামে যে হকপন্থী সে আল্লাহর সৈনিক বা আল্লাহর
সাহায্যকারী। পক্ষান্তরে যে হকের বিরোধীতা করে সে তাগুতের সৈনিক অর্থাৎ শয়তানের অনুসারী।
শয়তান সকল মানুষের শত্রু এমনকি তার যারা অনুসারী সে তাদেরও শত্রু অনুসারীদের সাথে করে
যদিও সে জাহান্নামে যাবে কিন্তু সে তাদের দায় গ্রহণ করবে না। বদলা গ্রহণের জন্য শয়তান
সবসময় প্ররোচনা দেয় এবং উস্কানি দেয়, ভীরু-কাপুরুষ শুধুই মার খাবে ২/৪ টা লাগাও। আল্লাহ
বলেন, শয়তানের প্ররোচনা অনুভব করলে তোমরা আল্লাহর আশ্রয়ে চলে এসো (সুরা হা-মীম আস সাজদা
৩৬)।
দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজ একান্তভাবে আল্লাহর।
মানুষের হেদায়াতের জন্য তিনি কিতাব ও নবি প্রেরণ করেছেন। যারা মানুষের কাছে দাওয়াত
পৌঁছায় তারা মূলত আল্লাহর সাহায্যকারী এবং এরা আল্লাহর কাছে অত্যন্ত মর্যাদাবান। দাওয়াত
দানের ক্ষেত্রে আল্লাহ নিজেই কৌশল শেখাচ্ছেন। কৌশলটা হলো, কেবল ইতিবাচক কাজ করা এবং
সর্বাবস্থায় পরম ধৈর্য অবলম্বন করা। বিশ্বাস রাখতে হবে, প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য আল্লাহই
যথেষ্ট। কিন্তু আল্লাহর কোনো তাড়াহুড়ো নেই। জালেমকে অবকাশ দান অর্থ এ নয় যে, হক ও বাতিলের
দ্বন্দ্ব সংগ্রামে আল্লাহ অনুপস্থিত রয়েছেন। জালেম জাহান্নামে চিরন্তন শাস্তি ভোগ করবে,
কখনই সে জাহান্নাম থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে না। ইনসাফের দাবী হলো, তাকে ফিরে আসার (তওবা
করার) সুযোগ দেয়া। পক্ষান্তরে যে আল্লাহরই জন্য নির্যাতিত হয়, তার তো হারাবার কিছু
নেই; রুহটা বের হওয়ার সাথে সাথে ফেরেশতারা তাকে অভিবাদন জানাতে থাকবেন এবং জান্নাতের
সুসংবাদ দান করবেন।
আল্লাহপাক নিজেই তাঁর নবি সা.-কে সবর করার
নির্দেশ প্রদান করেছেন এবং এই সবর একান্তভাবে আল্লাহর অনুগ্রহ। চতুর্দিক থেকে আসা মন্দের
জবাব ভালো দিয়ে দেয়া কাজটি সহজ নয়, এ-কাজটি তারাই পারে যারা ধৈর্য অবলম্বন করে ও অতীবও
ভাগ্যবান (সুরা হা-মীম আস সাজদা ৩৫)। কাফেরদের এই হীন আচরণে দুঃখ না করা এবং মনক্ষুণ্ণ
না হওয়ার জন্য আল্লাহ তাঁর নবি মুহাম্মদ সা.-কে সান্ত্বনা দিচ্ছেন এবং সন্ত্বনা নবির
সা. অনুসারী সকল বান্দার জন্যও।
সকল ভয়-ভীতি ও দুঃখ-কষ্টের ঊর্ধ্বে উঠে
দাওয়াতের ময়দানে টিকে থাকার জন্য আল্লাহপাক সাহস যুগিয়েছেন এই বলে যে, আল্লাহ মুত্তাকি
ও মুহসিনদের সাথে আছেন। দাওয়াতের ময়দানে যারা সক্রিয়, এই কাজটি তাদের নিছক ভালোলাগা
ও আবেগের বিষয় নয় বরং তাদের চিন্তা-চেতনা ও কাজে-কর্মে আল্লাহকে ভয় করে চলতে হবে এবং
তাদেরকে অবশ্যই সৎ কর্মশীল (মুহসিন) বান্দা হতে হবে। অর্থাৎ দাওয়াত দানকারীর চিন্তা-ভাবনা
হবে সবধরনের শিরক ও গোমরাহী থেকে মুক্ত এবং আচার-আচরণ ও কাজে-কর্মে তার মধ্যে আল্লাহর
নাফরমানির লেশমাত্র থাকবে না। এই ধরনের নেক বান্দাদের কোনো ভয় ও দুশ্চিন্তা নেই।
শিক্ষা :
মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকা সর্বোত্তম
কাজ। এই কাজ অপরিকল্পিত ও যেনতেনভাবে নয়। হেকমত ও সদুপদেশের মাধ্যমে নিরবচ্ছিন্নভাবে
পালন করে যেতে হবে।
অহেতুক বিতর্কে জড়ানো যাবে না। কিন্তু
বিতর্ক দেখা দিলে যুক্তি-পাল্টা যুক্তি দিয়ে বিজয়ী হওয়ার চেষ্টা করা সঠিক পদ্ধতি নয়।
আসলে বিতর্কে কখনো জয়ী হওয়া যায় না।
বাধা-বিপত্তি ও জুলুম-নির্যাতনের মোকাবেলায়
পরম ধৈর্য অবলম্বন করতে হবে।
নিজেকে আল্লাহর আশ্রয়ে দিয়ে প্রশান্তি
অনুভব করতে হবে এবং কখনই হতাশ হওয়া যাবে না।
দাওয়াত দানকারীকে বাস্তবজীবনে আল্লাহকে
ভয় করে চলা ও সৎ কর্মশীল বান্দা হতে হবে।
৩০.০৭.২০২১
Comments
Post a Comment