বিসমিল্লাহির
রহমানির রহীম
১. শপথ আসমানের, শপথ রাতের বেলায় আত্মপ্রকাশকারী (তারকা)-র
২. তুমি কি জান সে আত্মপ্রকাশকারী কী?
৩. তা হচ্ছে একটি সমুজ্জল তারকা,
৪. (যমীনের) এমন একটি প্রাণীও নেই যার ওপর কোন তত্ত্বাবধায়ক
নিযুক্ত (করা) হয়নি;
৫. মানুষ যেন তাকিয়ে দেখে-তাকে কোন্ জিনিস দিয়ে বানানো
হয়েছে?
৬. তাকে বানানো হয়েছে সবেগে স্খলিত (এক ফোটা) পানি
থেকে-
৭. যা বের হয়ে আসে (পুরুষদের) পিঠের মেরুদন্ড ও (নারীর)
বুকের (পাঁজরের) মাঝখান থেকে,
৮. নিশ্চিতভাবেই তিনি তাকে দ্বিতীয় বার সৃষ্টি করার
ক্ষমতা রাখেন,
৯. সেদিন (তার) যাবতীয় গোপন বিষয় যাছাই বাছাই করা হবে,
১০. (সেদিন) তার কোন শক্তিই থাকবে না, থাকবে না তার কোন
সাহায্যকারীও,
১১. বৃষ্টি বর্ষণকারী আকাশের শপথ,
১২. (বৃষ্টিধারায়) ফেটে যাওয়া যমীনের শপথ,
১৩. অবশ্যই এ (কুরআন) হচ্ছে (হক-বাতিলের চূড়ান্ত) পার্থক্যকারী
কথা,
১৪. তা অর্থহীন (কোন কিছু) নয়;
১৫. নিঃসন্দেহে এরা (আমার বিরুদ্ধে) চক্রান্ত করছে,
১৬. আমিও (এদের ব্যাপারে) একটি কৌশল অবলম্বন করছি,
১৭. অতএব তুমি (সে কৌশল দেখার জন্যে) কাফেরদের কিছু অবকাশ
দাও।
নামকরণ
: প্রথম বাক্যের আত তারিক শব্দকেই নাম হিসেবে
গ্রহণ করা হয়েছে।
নাযিলের
সময়কাল : বর্ণনাভঙ্গি বলে দেয় যে, এই সূরাটি রসূল (সা)-এর মক্কীযুগের প্রথম দিকে অবতীর্ণ।
তবে এই সূরার শেষের দিকে আয়াতসমূহের প্রেক্ষিতে বোঝা যায় যে, কুরআনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র,
চক্রান্ত এবং যে সময়ে বাধা শুরু হয় সে সময়ে এই সূরাটি নাযিল হয়।
বিষয়বস্তু
: মক্কীযুগের অন্যান্য সূরার মত এই সূরাটিতেও গুরুত্বের সাথে আখিরাতের বিষয়টি উপস্থাপন
করা হয়েছে। এ জন্য আল্লাহতায়ালা তাঁর সৃষ্টির কসম খেয়েছেন। আখিরাতে বিশ্বাসের ব্যাপারে
তৎকালে মানুষের ঘোর আপত্তি ছিল। মানুষ মরে যাবে, পচে-গলে মাটির সাথে মিশে যাবে এবং
আবার তাকে জীবিত করে তার যাবতীয় আমলের হিসাব নেয়া হবে ও বিচার হবে এবং বেহেশ্ত-দোযখ
দেয়া হবে, তাদের কাছে এটা ছিল বড় অবিশ্বাস্য। এ সমস্যা বর্তমান কালেও রয়েছে। মূলত সমাজে
জুলুম-নির্যাতন ও নানাবিধ পাপাচার এবং আল্লাহর নাফরমানির মূলে রয়েছে আখিরাতে বিশ্বাসের
দুর্বলতা।
আল্লাহপাক
আকাশ, যমীন ও তারকারাজির কসম খেয়েছেন। এদের সৃষ্টি ও সুনির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যে এদের
আবর্তন এবং মানুষের সৃষ্টি, মায়ের গর্বে তার ক্রমবিকাশ, দৈহিক গড়ন, জ্ঞান-বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন
করে সৃষ্টির সাথে সাথে একটি নির্দিষ্ট সময়কাল তার অবস্থান প্রমাণ করে যে, একজন শক্তিমান
ও নিপুণ কারিগর এর পশ্চাতে কাজ করছেন; তিনিই হচ্ছেন আল্লাহতায়ালা। যৌক্তিক কথা হলো,
তাঁর পক্ষে প্রথমে সৃষ্টি যেমন সম্ভব হয়েছে, তেমনি দ্বিতীয়বার সৃষ্টি করাও তাঁর জন্য
সহজ বিষয়। কুরআন আখিরাতের কথা স্পষ্ট করে বলে বিধায় অবিশ্বাসীদের কুরআনের প্রতি রয়েছে
সাংঘাতিক বিদ্বেষ। এই সূরার শেষের দিকে রসূল (সা)-কে শান্তনা দেয়ার সাথে সাথে প্রচ্ছন্নভাবে
কাফিরদেরকে সতর্কও করা হয়েছে।
ব্যাখ্যা
: আল্লাহপাক নিজেই তাঁর সৃষ্টির কসম খেয়েছেন।
তাঁর কথা এমনিতেই গুরুত্বের দাবী রাখে, তদুপরি শ্রোতৃমন্ডলী যাতে বিষয়টি আরো গুরুত্বের
সাথে গ্রহণ করে সে জন্য তিনি কসম খান। এখানে আকাশ, যমীন ও তারকারাজির কসম খেয়েছেন।
আকাশে দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান অসংখ্য তারকা রয়েছে। আসমান-যমীনসহ বিশালায়তনের এ সব নক্ষত্ররাজি
সবই গতিশীল অথচ কারো সাথে কারো সংঘর্ষ বা ছিটকে পড়া বা কোন দুর্ঘটনা নেই। এ সবই সম্ভব
হয়েছে কেবল আল্লাহতায়ালার নিপুণ ও কুশলী তত্ত্বাবধানের ফলে। আল্লাহর সৃষ্টিই তাঁর অস্তিত্ব
ও মহান শক্তিমত্তার প্রমাণ বহন করে।
এরপর
মানুষের সৃষ্টি আরো বিষ্ময়কর। পিতার কোটি শুক্রকীটের একটি মাতার অসংখ্য ডিম্বানু থেকে
একটি নিয়ে দুই এর সংমিশ্রণে মানুষ সৃষ্টি আল্লাহর অপার ক্ষমতা ও প্রজ্ঞারই ফল। এক ফোটা
লম্ফবান পানি যা বের হয়ে আসে পুরুষের পিঠের মেরুদন্ড ও নারীর বুকের পাঁজরের মাঝখান
থেকে পরিবর্তন বিবর্তনের মধ্য দিয়ে তা বৃদ্ধি পেতে পারে, কিন্তু তার মধ্যে দৈহিক কাঠামো,
নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে সংযোজন, প্রাণের সঞ্চার ও ক্রমবৃদ্ধি এবং এক সময় ভূমিষ্ট হওয়া,
মাতৃদুগ্ধপান, ক্রমান্বয়ে বেড়ে ওঠা, জ্ঞান-বুদ্ধির সঞ্চার এবং প্রত্যেকের স্বতন্ত্র
দৈহিক গড়ন, চেহারা, কণ্ঠস্বর ও বৃদ্ধাঙ্গুলির ছাপ-এর ভিন্নতা কি প্রমাণ করে যে, এ সব
কোন স্রষ্টা ও নিয়ন্ত্রক ছাড়াই সৃষ্টি হয়েছে ও পরিচালিত হচ্ছে। না, এর পেছনে রয়েছে
এক শক্তিমান ও কুশলি সত্তা এবং আল্লাহই হলেন সেই মহান সত্তা। এ সব সৃষ্টির পেছনে যে
আল্লাহ রয়েছেন, এ ব্যাপারে আরবের কাফির-মুশরিকদের আপত্তি ছিল না; আপত্তি ছিল মৃত্যুর
পর পুনরায় জীবন ও হিসাব-নিকাশে। আল্লাহতায়ালা সে কথাটিই স্মরণ করে দিয়ে বলেছেন যে,
প্রথমবার সৃষ্টি যদি সম্ভব হয়ে থাকে তাহলে দ্বিতীয়বার সৃষ্টিও সম্ভব। সেদিনটি হবে হিসাব-নিকাশের
দিন ও ফলভোগের দিন। তার সকল কর্ম এবং কর্মের পেছনে গোপন উদ্দেশ্য যা লুকিয়েছিল সবই
প্রকাশ করা হবে। সেদিন ব্যক্তির যেমন নিজের কোন ক্ষমতা থাকবে না, তেমনি কেউ তার সাহায্যেও
এগিয়ে আসবে না। পৃথিবীতে অর্জিত জ্ঞান-যোগ্যতা-ক্ষমতা-কর্তৃত্ব-ধন-সম্পদ-লোকবল সবই
দুনিয়ায় রেখে কেবল নেক ও বদ আমল নিয়ে তাকে
আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হতে হবে।
আকাশ
থেকে বৃষ্টি বর্ষণ এবং তার ফলে যমীন শস্য-শ্যামল হয়ে ওঠা কোন সাধারণ ব্যাপার নয়; এটা
আল্লাহপাকের হুকুম ও নিরেট বাস্তবতা। মানুষকে পুনরায় আল্লাহর কাছে ফিরে যাওয়ার কথা
এই কুরআন বলে থাকে; এটা কোন হাসি-ঠাট্টার বিষয় নয়, সেদিন এটিই হবে সত্য ও বাস্তব। কুরআন
হক ও বাতিলের কথা স্পষ্ট করে তুলে ধরে, অন্ধকার দূর করে মানুষকে আলোর পথে নিয়ে আসে;
তাই কুরআনের প্রতি ও এর দাওয়াত পেশকারী নবীর প্রতি অন্ধকারের কীট কাফির-মুশরিকদের চরম
বিদ্বেষ এবং কুরআনের আওয়াজ বন্ধ করে দেয়ার জন্য তারা নানা ধরনের ষড়যন্ত্র-চক্রান্তে
লিপ্ত থাকে। এ ধারা অব্যাহত রয়েছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত চলবে। কাফিরদের এই ষড়যন্ত্র চক্রান্তের
বিরুদ্ধে আল্লাহও তাঁর কৌশল অব্যাহত রেখেছেন এবং কুরআনের আওয়াজ তিনি বুলন্দ করেই ছাড়বেন।
কাফিরদেরকে কিছুকাল অবকাশ দানের কথা বলে আল্লাহপাক তাঁর নবীকে শান্তনা দান করেছেন।
কোন পেরেশানী অনুভব না করে নবীর ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে যাওয়ায় তাঁর দায়িত্ব।
আসলে কুরআনের আওয়াজ বুলন্দ করার দায়িত্ব একান্তই আল্লাহর এবং কোন্ কৌশলে করবেন সেটা
তিনিই জানেন। এ সব কথাবার্তা সে সময়ের, যে সময়ে নবী (সা) ও তাঁর স্বল্প সংখ্যক সাথীর
জীবনটা ছিল সংকীর্ণ এবং প্রকাশ্যে কুরআনের আওয়াজ পেশ করা ছিল বড় ঝুঁকিপূর্ণ। সেই আল্লাহই
একদিন মক্কাভূমি থেকে বিতাড়িত নবী (সা) ও তাঁর কুরআনকে প্রতিষ্ঠিত করে দেন।
শিক্ষা
: আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস আনায়নই সূরার মূল প্রতিবাদ্য বিষয়। আসমান-যমীন ও তারকারাজি
এবং মানুষের অস্তিত্বই প্রমাণ করে এ সব কোন দুর্ঘটনার ফল নয়, একজন কুশলী ও শক্তিমান
স্রষ্টার সৃষ্টি; বড় বিজ্ঞোচিত পন্থায় তিনি এর রক্ষণাবেক্ষণ করছেন। এই কুরআন তাঁরই
প্রদত্ত হেদায়াত এবং অত্যন্ত যৌক্তিকভাবে আখিরাতের অপরিহার্যতা তুলে ধরে। মানুষ সৃষ্টির
সেরা ও নৈতিক জীব হওয়ার পাশাপাশি আল্লাহর পক্ষ থেকে হেদায়াত লাভের কারণে এ দুনিয়ায়
তার সাধিত সকল কাজকর্মের হিসাব গ্রহণ করা হবে। দুনিয়ার ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব যেমন সেদিন
তার কোন কাজে আসবে না, আবার কাউকে কোন সাহায্যকারী হিসাবেও পাবে না। তাই সবারই উচিৎ
দুনিয়া থেকে পরকালের পাথেয় সংগ্রহ করে নেয়া।
Comments
Post a Comment