Skip to main content

সূরা ৮৭ আল আ’লা মাক্কী সূরা ও আয়াত সংখ্যা ১৯


বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম

০১.  তসবিহ্ করো তোমার মহান প্রভুর নামের,
০২.  যিনি সৃষ্টি করেছেন এবং সুষম করেছেন,
০৩.  যিনি সামঞ্জস্যপূর্ণ অনুপাত নির্ধারণ করেছেন এবং পথ প্রদর্শন করেছেন।
০৪.  এবং যিনি (জমিন থেকে) বের করে আনেন উদ্ভিদ।
০৫.  তারপর সেগুলোকে পরিণত করেন কালো আবর্জনায়।
০৬.  আমি তোমাকে পড়িয়ে দেবো (কুরআন), তারপর তুমি আর তা ভুলবেনা।
০৭.  তবে আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন, নিশ্চয়ই তিনি জানেন প্রকাশ্য এবং গোপনীয় সবকিছু।
০৮.  আমি তোমার জন্যে সহজ পথকে সহজ করে দেবো।
০৯.  তাই তুমি (মানুষকে) উপদেশ দিতে থাকো, যদি উপদেশ তাদের উপকারে আসে।
১০.  ঐ ব্যক্তি অবশ্যি উপদেশ গ্রহণ করবে, যে ভয় করে (আল্লাহকে)।
১১.  আর তা উপেক্ষা করবে ঐ ব্যক্তি, যে বড়ই দুর্ভাগা,
১২.  যে প্রবেশ করবে সাংঘাতিক আগুনে।
১৩.  অতঃপর সে সেখানে মরবেওনা, বাঁচবেওনা।
১৪.  নিশ্চয়ই সাফল্য অর্জন করবে ঐ ব্যক্তি, যে তাযকিয়া করবে,
১৫.  এবং তার প্রভুর নামে যিকির (উচ্চারণ, আলোচনা, স্মরণ) করবে, আর আদায় করবে সালাত।
১৬.  কিন্তু তোমরা প্রাধান্য দিয়ে চলছো দুনিয়ার হায়াতকে।
১৭.  অথচ আখিরাত (-এর হায়াতই) হবে উত্তম এবং তা বাকি (স্থায়ী) থাকবে চিরকাল।
১৮.  নিশ্চয়ই এই উপদেশ পূর্বের সহিফাগুলোতেও (কিতাবগুলোতেও) রয়েছে,
১৯.  ইবরাহিম এবং মুসার সহিফায়।


নামকরণ : সূরার প্রথম বাক্যে উল্লেখিত শব্দ আলাকে নাম হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে।
নাজিলের সময়কাল : এই সূরার ৬ষ্ঠ নং আয়াত, আমি তোমাকে পড়িয়ে দেবো (কুরআন), তারপর তুমি আর তা ভুলবেনা-এই বাক্যটি বলে দেয় যে, এই সূরাটি একেবারে প্রাথমিক অবস্থায় অবতীর্ণ সূরা। ওহী অবতীর্ণের বিষয়ে রসূল (সা) তখনও অভ্যস্ত হয়ে ওঠেননি, তাই তিনি ভুলে যাবার আশঙ্কা করতেন। সূরা ত্ব-হার ১১৪ নং আয়াত ও সূরা কিয়ামাহর ১৬-১৯ আয়াত মিলিয়ে পড়লে বোঝা যায় যে, প্রথমে সূরা আলায় বলা হয়েছে যে পড়িয়ে দেয়ার দায়িত্ব আল্লাহর এবং তুমি কখনই ভুলে যাবে না। এরপর সূরা কিয়ামাহ বলা হয়েছে যে, মুখস্থ করার জন্য দ্রুত জিহবা সঞ্চালনের দরকার নেই, আমরা যখন পড়ি তখন মনোযোগ সহকারে শুনতে থাকো এবং সর্বশেষ স্মৃতি থেকে হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় সেগুলো স্মরণে রাখার জন্য তিনি বারবার চেষ্টা করতে থাকেন, এমতাবস্থায় সূরা ত্ব-হায় বলা হয়েছে যে, কুরআন পড়ার ব্যাপারে তাড়াহুড়া করো না, যতক্ষণ পর্যন্ত তোমার কাছে ওহী সম্পূর্ণ পৌঁছে না যায়। পরবর্তীতে আর কখনও এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি।

বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য : এই সূরায় তিনটি বিষয় আলোচিত হয়েছে। প্রথমত তাওহীদ, দ্বিতীয়ত রসূল (সা)-এর দায়িত্ব এবং তৃতীয়ত পরকাল। আল্লাহর নামে তাসবীহ পাঠ অর্থাৎ আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা। আল্লাহর জন্য যেটা শোভনীয় অর্থাৎ যে সব শব্দে দুর্বলতা-অক্ষমতা ও ত্রুটি-বিচ্যুতি লেশমাত্র প্রকাশ না পায় সে সব শব্দে তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা করতে হবে। কুরআন মজিদে সুন্দর সুন্দর নামে তাঁকে স্মরণ করার কথা বলা হয়েছে। এরপর তিনি তাঁর পরিচয় পেশ করেছেন এভাবে যে তিনি সৃষ্টি করেছেন, সুষম করেছেন অর্থাৎ অতি উত্তম কাঠামোয় সৃষ্টি করেছেন এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে সুসামঞ্জস্যপূর্ণ করেছেন ও চলার পথ-নির্দেশনা (হেদায়াত) দান করেছেন। মানুষের জীবন ধারণের জন্য জমিনকে শস্য-শ্যামল করেছেন এবং এক সময় এ সব উদ্ভিদরাজিকে কালো আবর্জনায় পরিণত করেন। এরপর আল্লাহর পক্ষ থেকে কুরআন পড়িয়ে দেয়ার ও কখনই ভুলে না যাওয়ার গ্যারান্টি দেয়া হয়েছে। আল্লাহপ্রদত্ত হেদায়াতকে সহজ বলে উল্লেখ করা হয়েছে এবং তা বোঝা ও পালনের ক্ষেত্রেও সহজ করে দেয়া হয়েছে। মানুষকে উপদেশ দানের জন্য বলা হয়েছে এবং এ ক্ষেত্রে যে আগ্রহী তাকে গুরুত্ব দানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যে উপদেশ গ্রহণ করবে না সে বড় হতভাগা ও তার কঠিন পরিণতির কথা বলা হয়েছে। পক্ষান্তরে সাফল্য লাভ করবে সে, যে নিজেকে পবিত্র রাখে ও আল্লাহর স্মরণ ও নামায আদায় করে। দুনিয়ার জীবনের তুলনায় আখিরাতের জীবনের স্থায়িত্ব ও উত্তম হওয়ার কথা স্পষ্ট করা হয়েছে।

ব্যাখ্যা : আল্লাহপাককে স্মরণ ও তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা করার জন্য সুন্দর সুন্দর নাম রয়েছে। বড়ত্ব, শ্রেষ্ঠত্ব, মহানত্ব ও মহানুভবতা প্রকাশ পায় এমন শব্দেই তাঁকে স্মরণ করতে হবে। সামান্যতম শিরকের সংমিশ্রণ বা অপবিত্রতা বা কাউকে তাঁর সমকক্ষ প্রকাশ পায় এমন শব্দ তাঁর উদ্দেশ্যে বলা যাবে না। আবার অপবিত্র অবস্থায় বা গুনাহের কাজে লিপ্ত বা যে মাহফিলে তাঁর নামের অমর্যাদা হয় এমনাবস্থায়ও তাঁর নাম উচ্চারণ করা যাবে না। আল্লাহর যে সব গুণবাচক নামে তাঁর বান্দাদের নাম রাখা হয় (রহিম, করিম, জলিল, কাদির ইত্যাদি) বড় সতর্কতার সাথে তাঁর বান্দাদেরকে আব্দুর রহিম, আব্দুল করিম, আব্দুল জলিল-এভাবে ডাকতে হবে। ভিক্ষুক বা সাহায্যপ্রার্থীকে সাহায্যদানে অপারগ হলে আল্লাহর ওয়াস্তে মাফ করো না বলে ভাই, মাফ করো বলাটাই উত্তম। কারণ প্রার্থীর আল্লাহর প্রতি বিরক্তি আসতে পারে। আল্লাহর শান ও মর্যাদা বিবেচনা করে আল্লাহর নাম উচ্চারণ ও তাঁকে অনুভব করা উচিৎ। কুরআন মজিদের বিভিন্ন ইশারা ইংগিত নিয়েই মূলত নামায। এই সূরার প্রথম আয়াতের প্রেক্ষিতে রসূল (সা) নামাযের সিজদায় ছুবহানা রাব্বিয়াল আলা এবং সূরা ওয়াকিয়ার শেষ আয়াত ফাছাব্বি বিছমে রাব্বিকাল আজীম থেকে রুকুতে ছুবহানা রাব্বিয়াল আজীম নির্ধারণ করেছেন।

সকল সৃষ্টির মালিকানা আল্লাহ। একটি সুষম পদ্ধতিতে তিনি সবকিছু সৃষ্টি করেছেন, এক অতি উত্তম কাঠামোয় এবং কোথাও কোন অসামঞ্জস্য নেই। আমরা যদি আমাদেরকে নিয়েই একটু চিন্তা করি তাহলে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়বো। হযরত আদম (আ) থেকে আজ  পর্যন্ত নয়, কিয়ামত পর্যন্ত কোটি কোটি মানুষ স্বতন্ত্র দৈহিক কাঠামো, চেহারা, কণ্ঠস্বর ও স্বতন্ত্র বৃদ্ধাঙ্গুলির ছাপ নিয়ে এই পৃথিবীতে আগমন ঘটেছে বা ঘটবে। কত বিজ্ঞ ও কুশলী আমার আল্লাহ। আবার তিনি প্রত্যেকের তকদির নির্ধারণ করে দিয়েছেন, অর্থাৎ তার অবস্থান, কার্যক্রম, ধ্বংস সবকিছু সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। সাথে সাথে পথপ্রদর্শন অর্থাৎ কিভাবে চলবে, বেড়ে উঠবে, খাদ্যখানা গ্রহণ করবে, কার্যক্রম পরিচালনা করবে সবই আল্লাহর হেদায়াত অনুসারে সম্পন্ন হয়ে থাকে এবং এই দৃষ্টিকোণ থেকে আল্লাহর সকল সৃষ্টি মুসলিম অর্থাৎ অনুগত। সৃষ্টির সেরা মানুষের দুটি সত্তা-এক. জৈবিক সত্তা যেখানে অন্যান্য সৃষ্টির মত প্রাকৃতিক নিয়মের অনুসরণ করে, দ্বিতীয়ত. আল্লাহর পক্ষ থেকে নবী-রসূলদের মাধ্যমে হেদায়াত, যেটা অনুসরণের মধ্য দিয়ে মানুষের জান্নাত-জাহান্নামের ফয়সালা হবে।

আল্লাহপাক তাঁর দেয়া পথকে সহজ বলেছেন। ফিতরাতের ধর্ম ইসলাম মানুষের স্বভাব-প্রকৃতির সাথে পূর্ণরূপে সামঞ্জস্যশীল এবং এই সহজ পথটাকে মেনে চলার জন্য আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে সহজ করে দিয়েছেন। আল্লাহপ্রদত্ত এ দ্বীনকে তাঁর বান্দাদের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য তিনি তাঁর নবীকে নির্দেশ করেছেন এবং এই পৌঁছে দেয়াটাই তাঁর দায়িত্ব। উপদেশ দানের ক্ষেত্রে যে আগ্রহী তাকে অগ্রাধিকারদান এবং যে আল্লাহকে ভয় করে সে উপদেশ গ্রহণ করবে বলে জানিয়েছেন। পক্ষান্তরে যে অবহেলা করে তাকে বড় দুর্ভাগা এবং তার পরিণতি হবে জাহান্নাম, সেখানে সে মরবেও না আবার বাঁচবেও না। তার শাস্তিভোগ হবে চিরন্তন এবং মৃত্যুর মধ্য দিয়ে শাস্তির অবসান কখনই হবে না। বাঁচবেও না বলতে সম্মান, মর্যাদা ও আরাম-আয়েশের সাথে জীবন-যাপনও হবে না। কাফির-মুশরিক ও মুনাফিকদের জন্যই মূলত চিরন্তন আযাব; পক্ষান্তরে মুমিনদের গুনাহের শাস্তিভোগের পর এক পর্যায়ে জান্নাতে যাবে।

পবিত্রতা অবলম্বন বলতে কুফর-শিরক ত্যাগ করে ঈমান আনা ও অসৎ আচার-আচরণ-অসৎ কাজ ত্যাগ করে সদাচার ও সৎ আমল অবলম্বন করা বোঝায় এবং সাফল্য বলতে দুনিয়া ও আখিরাতে সাফল্য বোঝায়। আল্লাহর স্মরণ বলতে অন্তরে অনুভব, মুখে উচ্চারণ ও কাজে প্রমাণ দেয়া। এর সাথে নামাযের উল্লেখ করায় বোঝা যায় আল্লাহকে শুধু ইলাহ বলে স্বীকার করলেই হবে না বরং তাঁর আনুগত্যের প্রমাণ হিসেবে নামায আদায় করতে হবে। মানুষ বড় দুনিয়াকেন্দ্রিক, দুনিয়ার আরাম-আয়েস, সুখ-স্বাচ্ছন্দকেই সে প্রাধাণ্য দিয়ে থাকে। অথচ দুনিয়া অপেক্ষা আখিরাত অনেক উত্তম। কারণ দুনিয়ার তুলনায় আখিরাতের নেয়ামত ও সুখ-সম্ভোগ অনেক অনেক বেশি এবং দুনিয়া ধ্বংসশীল কিন্তু আখিরাত স্থায়ী। এ সব আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর বান্দাদের উদ্দেশ্যে উপদেশ; শুধু কুরআনেই নেয়, পূর্ববর্তী কিতাবসমূহে উল্লেখ করা হয়েছে।

শিক্ষা : মক্কীযুগে ছোট্ট ছোট্ট এ সব সূরার বৈশিষ্ট্যই হলো উপদেশ দান। মানুষ আল্লাহর বড়ত্ব অনুভব করবে এবং তাঁর আনুগত্যের মাধ্যমে আখিরাতে চিরন্তন সুখ-স্বাচ্ছন্দ ভোগ করবে, এটাই আল্লাহর অভিপ্রায়। ক্ষণস্থায়ী এ দুনিয়ার সুখ-সম্ভোগের লক্ষ্যে মানুষ পরকাল বিসর্জন দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তা থেকে ফিরিয়ে আখিরাতে সাফল্য লাভের দিকে মানুষকে এগিয়ে নেয়াই এ সূরার লক্ষ্য।

Comments