Skip to main content

সূরা ৮৮ আল গাশিয়া (আচ্ছন্নকারী) মাক্কী সূরা ও আয়াত সংখ্যা ২৬


বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম

০১. তোমার কাছে কি আচ্ছন্নকারী (কিয়ামত) দিবসের খবর পৌঁছেছে?
০২. সেদিন অনেক চেহারা হবে ভীত-নত অপমানিত,
০৩. শ্রম-ক্লান্ত।
০৪. তারা প্রবেশ করবে জ্বলন্ত আগুনে।
০৫. তাদের পান করানো হবে তাপ-দাহে ফুটন্ত ঝর্ণার পানি।
০৬. তাদের জন্যে সেখানে বিষাক্ত কাঁটাদার শুকনো ঘাস-গুল্ম ছাড়া থাকবেনা আর কোন খাদ্য,
০৭. যা তাদের পুষ্টিও যোগাবেনা, ক্ষুধাও মেটাবেনা।
০৮. (অপরপক্ষে) সেদিন অনেকের মুখমন্ডল হবে আনন্দে উজ্জ্বল।
০৯. সেদিন তারা খুশি হবে তাদের (দুনিয়ার জীবনের) প্রচেষ্টার জন্যে।
১০. তারা থাকবে অতি উন্নত জান্নাতে।
১১. সেখানে তারা শুনবেনা কোন ক্ষতিকর ও বাজে কথা।
১২. সেখানে থাকবে ঝর্ণা বহমান,
১৩. থাকবে অতি উন্নত শয্যা,
১৪. হাতের কাছেই রাখা হবে পানপাত্রসমূহ,
১৫. সাজানো থাকবে সারি সারি (নরম) বিছানা,
১৬. (সর্বত্র) বিছানো থাকবে উন্নত গালিচা।
১৭. তোমরা কি নজর করে দেখতে পারছোনা উটের দিকে, কিভাবে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে?
১৮. এবং আসমানের দিকে, কিভাবে তাকে উপরে উঠিয়ে রাখা হয়েছে?
১৯. আর পর্বতমালার দিকে, কিভাবে তাকে গেড়ে রাখা হয়েছে?
২০. এবং পৃথিবীর দিকে, কিভাবে তাকে বিছিয়ে দেয়া হয়েছে?
২১. অতএব, তুমি তাদের উপদেশ দিয়ে যাও। কারণ, তুমি তো কেবল একজন উপদেশদাতাই।
২২. তুমি তাদের উপর শক্তি প্রয়োগকারী নও।
২৩. তবে যে (তোমার উপদেশ মেনে নেয়ার পরিবর্তে) মুখ ফিরিয়ে নেবে এবং অবলম্বন করবে কুফুরির পথ,
২৪. আল্লাহ তাকে আযাব দেবেন, গুরুতর আযাব।
২৫. আমার কাছেই হবে তাদের প্রত্যাবর্তন।
২৬. তারপর তাদের হিসাব নেয়ার দায়িত্ব আমারই।
নামকরণ : সূরার প্রথম শব্দকেই নাম হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে।
নাজিলের সময়কাল : মক্কা-মুয়াজ্জামায় রসূল (সা)-এর দাওয়াতের প্রাথমিক অবস্থায় অবতীর্ণ সূরাসমূহের এটি একটি। আল্লাহর নির্দেশক্রমে নবী মুহাম্মদ (সা) ইসলামের দাওয়াত দান শুরু করলে প্রথম দিকে আরবের লোকেরা উপেক্ষার নীতি অবলম্বন করতে থাকে এবং কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর অত্যাচার-নির্যাতন শুরু হয়। এই সূরার বর্ণনাভঙ্গিতে মনে হয় তখনও জুলুম-নির্যাতন তেমন শুরু হয়নি।

বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য : এই সূরায় দু’টি বিষয় আলোচিত হয়েছে। প্রথমত: ১-১৬ আয়াতে পরকালে অবিশ্বাসীদের দুরবস্থা ও মু’মিনদের সুখ ও আনন্দের বর্ণনা। দ্বিতীয়ত: আল্লাহর সৃষ্টি কৌশল এবং নবীর দায়িত্ব বর্ণনা। তাঁর দায়িত্ব মানুষকে উপদেশ দান, বলপ্রয়োগ করে কাউকে ইসলামে প্রবেশ করানো নয়। আখেরাতের শাস্তি ও পুরস্কারের সত্যতা বর্ণনা করে মানুষকে ইসলাম গ্রহণে উদ্বুদ্ধকরণই এই সূরার মূল উদ্দেশ্য। রসূল (সা)-এর দাওয়াতের মূল বিষয় ছিল মানুষকে তাওহীদ ও আখিরাতে বিশ্বাসী বানানো। আল্লাহ সম্পর্কে তৎকালে মানুষের একটি ধারণা ছিল। তারা নিরেট নাস্তিক ছিল না। তারা আল্লাহকে বিশ্বাস করতো। কাবাকে বায়তুল্লাহ হিসেবে জানতো, নিজেদের সন্তানদের নাম রাখতো আব্দুল্লাহ এবং মুহাম্মদ (সা)-এর পিতার নাম ছিল আব্দুল্লাহ। কিন্তু তারা আল্লাহর সাথে শিরক করতো। তারা আল্লাহকে এককভাবে না মেনে তাঁর সাথে অনেককে অংশীদার মানতো। আরবের লোকদের বড় সমস্যা ছিল আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস নিয়ে। দুনিয়ার সকল কৃতকর্মের আবার জবাবদিহি করতে হবে এবং ভালো কাজের পুরস্কার ও মন্দ কাজের শাস্তি ভোগ করতে হবে এমন চিন্তা-চেতনা কখনই তারা পোষণ করতো না। এ সমস্যা এখনও বর্তমান। আজকের সমাজের গুম-খুন, জুলুম-নির্যাতন, নগ্নতা-বেয়াহাপনা-অশ্লীলতা, সুদ-ঘুষ, যিনা-ব্যভিচার ও নানাবিধ পাপাচারের মূলে রয়েছে আখিরাতের প্রতি বিশ্বাসহীনতা বা বিশ্বাসে দুর্বলতা। তাই আল্লাহপাক তাঁর নবীর মাধ্যমে মানুষকে আখিরাতেবিশ্বাসী করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে নবুয়াতের প্রথম দিকে ছোট্ট ছোট্ট সূরায় আখিরাতকেন্দ্রিক বর্ণনা বেশি বেশি করেছেন।

বর্তমান পৃথিবী যে শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতার ওপর চলছে তা এক শক্তিমান ও কুশলী মহান স্রষ্টার ইচ্ছার প্রেক্ষিতেই সম্ভব। তিনিই একদিন এই শৃঙ্খলা ভেঙ্গে দেবেন। এক প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্পের মাধ্যমে গোটা বিশ্বপ্রকৃতি ভেঙ্গে খানখান হয়ে যাবে এবং সাগর-মহাসাগর, পাহাড়-পর্বত সব চুরমার হয়ে এক সমতল ভূমিতে পরিণত হবে। তারপর বিচারানুষ্ঠানের মাধ্যমে পাপীকে তার পাপের বদলা এবং পুণ্যবানকে তার ভালো কাজের পুরস্কার দানের কথা মক্কীযুগে অবতীর্ণ সূরা ও আয়াতসমূহে বারবার বলা হয়েছে। আল্লাহপাক মানুষকে ভালোকে ভালো এবং মন্দকে মন্দ জানার মত একটি বিবেক দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। তারপরও মন্দকে পরিহার করে ভালো পথে চলার ক্ষেত্রে নবী-রসূল ও কিতাবের মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ করেছেন এবং এই সূরার শেষাংশে নবীর দায়িত্ব হিসেবে মানুষকে উপদেশ দানের কথা উল্লেখ করেছেন। আর এই উপদেশ দানের ভিত্তিই হলো আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস। শুধু এই বিশ্বাসের বলে আরবের অসভ্য ও বর্বর জাতিটা পৃথিবীর সেরা সভ্য জাতিতে পরিণত হয়।

ব্যাখ্যা : গাফেলতিতে নিমজ্জিত একটি জনগোষ্ঠীকে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে এই বলে যে তোমাদের কাছে কি বিভিষিকাময় কিয়ামতের খবর পৌঁছেছে? তাদের পাপপঙ্কিল জীবন সম্পর্কে সতর্কীকরণই মূলত এভাবে বলার উদ্দেশ্য। সমাজে সকল পাপের মূল হলো আখেরাতের প্রতি বিশ্বাসহীনতা। মানুষ যদি যথার্থভাবে আখিরাতের প্রতি বিশ্বাসী হয় তাহলে তার পক্ষে আল্লাহর নাফরমানী বা পাপাচারে লিপ্ত হওয়া কখনই সম্ভব নয়। দুই ধরনের মানুষের আখেরাতে দুই ধরনের পরিণতির কথা এখানে উল্লেখ করা হয়েছে। বর্তমান দুনিয়ায় যারা আল্লাহর নাফরমানি করছে বা পাপাচারে লিপ্ত, লক্ষ্য করা যায় তারা অনেক ধন-দৌলত, ক্ষমতা ও প্রভাব-প্রতিপত্তির অধিকারী এবং নির্বিচারে সমাজে জুলুম-নির্যাতন করে যাচ্ছে। কিন্তু সেদিন তারা ভীত, নত, ক্লান্ত-শ্রান্ত অবস্থায় আখিরাতে উত্থিত হবে। কিয়ামতের দিন পাপিষ্ঠদের অবস্থা কুরআন ও হাদিসে নানাভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। লোহার শিকল দিয়ে বেঁধে তাদেরকে হাজির করানো হবে। অর্থাৎ লাঞ্ছনা-অপমান-শাস্তির যত প্রকার আছে সবই তাদের ওপর প্রয়োগ করা হবে। আল্লাহপাক নানাভঙ্গিতে কিয়ামতের বর্ণনা ও তাদের শাস্তির কথা উল্লেখ করেছেন যাতে তারা সতর্ক ও সংশোধিত হয়। এ সব পাপিষ্ঠ ও জালেমদের আবাস হবে জ্বলন্ত আগুন। সেখানে তাদের পানীয় হবে ফুটন্ত পানি এবং খাবার হবে বিষাক্ত ও কাঁটাযুক্ত শুকনো ঘাস। আবার কোথাও বলা হয়েছে খাদ্য হিসেবে তারা পাবে ‘জাক্কুম’ ও ‘গিসলিন’। এ সবের মধ্যে কোন বৈপরীত্ত নেই। অপরাধীর শ্রেণীভেদে বা একটি খেতে না চাইলে অন্যটি দেয়া হবে। জাহান্নামীদের ক্ষুধা থাকবে তীব্র, কিন্তু এ সব খাবার তাদের ক্ষুধা নিবারণ বা পুষ্টি যোগাবে না। তারা এত পিপাসার্ত থাকবে যে ফুটন্ত পানি ঢক ঢক করে খেতে থাকবে এবং এতে তাদের নাড়ি-ভুঁড়ি গলে বের হয়ে যাবে। আবার তারা এত ক্ষুধার্ত হবে যে, সামনে যা পাবে তাই গোগ্রাসে গিলতে থাকবে এবং শুকনো বিষাক্ত ও কাঁটাযুক্ত ঘাস তাদের গলায় আটকে যাবে। হাদিসে জাহান্নামীদের অবস্থার নানা বর্ণনা রয়েছে। তাদের গায়ের চামড়া ঝলসে যাওয়ার পর আবার চামড়া গজিয়ে উঠবে এবং তাদের শরীর অনেক বড় হবে। আর এ সব শাস্তি কোন নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নয়, বরং অনন্তকালের জন্য যা কখনই শেষ হবে না। দুনিয়ার জীবনে জালেম শাসকগোষ্ঠী ও তাদের নানা বাহিনী মানুষকে শাস্তিদানের জন্য নানা কৌশল উদ্ভাবন করেছে। কিন্তু আল্লাহপাকের শাস্তির সাথে এ সব শাস্তি কোনভাবেই তুলনীয় নয়। কুরআন ও হাদিসে বর্ণিত এ সব শাস্তি সম্পর্কে যদি বিশ্বাস ও উপলব্ধি থাকে তাহলে কখনই কি সম্ভব মানুষের পক্ষে পাপাচারে লিপ্ত হওয়া?

পাপিষ্ঠদের শাস্তির পাশাপাশি আল্লাহর নেককার বান্দাদের মহা পুরস্কারের কথা এখানে উল্লেখ করা হয়েছে। সেদিন আল্লাহর নেক বান্দাদের চেহারায় থাকবে খুশির ঝিলিক। আনন্দে আত্মহারা হয়ে প্রিয়জনদের সাথে কুশল বিনিময় করবে এবং আল্লাহর প্রতিশ্রুত সব নেয়ামত পেয়ে তারা থাকবে পরিতৃপ্ত। দুনিয়ার জীবনে পবিত্র জীবন-যাপন, আল্লাহর বিধি-বিধান অনুসরণ ও তাঁর বিধান অনুসরণ করতে যেয়ে সকল বাধা-বিপত্তি, জুলুম-নির্যাতন-প্রাণহানি সব কিছুর বিনিময়ে সে লাভ করবে মহাসুখের স্থান জান্নাত। এ সব পেয়ে দুনিয়ার জীবনের সকল কষ্ট, জুলুম-নির্যাতন সবকিছু সে ভুলে যাবে। কারণ তার রব তাকে পূর্ণ প্রতিদান দেবেন এবং সবকিছু পেয়ে সে আল্লাহর প্রতি খুশি হয়ে যাবে ও আল্লাহও তাঁর বান্দাহর প্রতি খুশি হয়ে যাবেন। কুরআন-হাদিসে জান্নাতের নেয়ামতসমূহের নানা বর্ণনা রয়েছে। এখানে কিছু বর্ণনা দেয়া হয়েছে। সেখানে উন্নত জান্নাত, ঝর্ণা প্রবাহমান, নরম বিছানা, পানপাত্রসমূহ সাজানো ও গালিচা বিছানো থাকবে। দুনিয়ার জীবনে রাজা-বাদশাহরা যে আরাম-আয়েশ, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ভোগ করে একজন সাধারণ মানের মুসলমানর তার চেয়ে অনেক অনেক উন্নতমানের জীবন-যাপন করবে। আসলে জান্নাতের যে সুখ-আরাম-আয়েশ তা কোনভাবেই তুলনা করা যাবে না। সে যা চাবে তাই পাবে এবং যা ইচ্ছা করবে সেটাই হবে। আল্লাহর ভাষায় এ সবই মেহমানদারীর সামগ্রী। নেক বান্দাদের পরিচয় হবে তারা আল্লাহর মেহমান। জান্নাতের একটি বড় নেয়ামত হবে সেখানে কোন ক্ষতিকর ও বাজে কথা থাকবে না। শুধুই কল্যাণকর কথা। ঈমানদাররা যা নন এই দুনিয়ায় তাই তাদেরকে শুনতে হচ্ছে, হাজারো মিথ্যা অপবাদ দিয়ে মানুষের কাছে হেয় করার কত প্রাণান্তকর প্রয়াস, সেদিন সবই শেষ হয়ে যাবে। আখিরাত একান্তভাবে মু’মিনদের, সেখানে কাফির-মুশরিকদের কোন অংশ নেই। মু’মিনদের জন্য সুখ, সুখ আর সুখ আর কাফিরদের জন্য দুঃখ, কষ্ট ও যন্ত্রণা। মু’মিনদের সেই সমাজে থাকবে না পরস্পরে কোন হিংসা-বিদ্বেষ ও বাজে কথা। সর্বত্রই পবিত্রতার ছাপ।

দ্বিতীয় অংশে আল্লাহর সৃষ্টি কৌশল উল্লেখ করে মানুষের পুনরুত্থান ও জান্নাত-জাহান্নাম সৃষ্টির যৌক্তিকতা ও সম্ভাব্যতা তুলে ধরা হয়েছে এবং নবীর দায়িত্ব বর্ণনা করা হয়েছে।

আল্লাহর নাফরমানি ও যুলুম-নির্যাতনের পেছনে বড় কারণ হলো আখিরাতের প্রতি অবিশ্বাস। এই দুনিয়ায় ভালো কাজের বদলা হিসেবে আখিরাতে চিরন্তন জীবনে অসংখ্য নেয়ামতেভরা জান্নাতের সুখ উপভোগ করা এবং মন্দ কাজের পরিণতি হিসেবে জাহান্নামের ভয়াবহ আযাবের মুখোমুখি হওয়া-কারো মাঝে এ বিশ্বাস দৃঢ় হলে সে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আল্লাহর নাফরমানি পরিহার করে ভালো পথে চলবে। আল্লাহপাক তাঁর বান্দাদের জন্য অত্যন্ত দয়ার্দ। তাকে ভালো-মন্দ উপলব্ধির মত বিবেক-বুদ্ধি দানের সাথে সাথে কিতাব ও নবী প্রেরণ করেছেন।

মানুষ এই দুনিয়ার জীবন, তার অবস্থান, আল্লাহর সৃষ্টিকৌশল বাস্তবে দেখছে, তাই এতে তার অবিশ্বাসের কিছু নেই। কিন্তু আল্লাহর জিজ্ঞাসা মরুভূমির উপযোগী করে সৃষ্টি উট, এই আসমান, পাহাড়-পর্বত, জমিন এ সব সৃষ্টি কি কোন আকস্মিক দুর্ঘটনার ফল না কোন শক্তিমান ও কুশলী স্রষ্টার সৃষ্টি। আল্লাহর সৃষ্টি তাঁর অস্তিত্ব এবং চরম ক্ষমতা ও প্রজ্ঞারই পরিচয় বহন করছে। আরবের মরুভূমিতে আল্লাহপাক তাঁর শেষ নবী মুহাম্মদ (সা)-কে প্রেরণ করেন। নবী তাঁর জাতিকে আখিরাতের ভয় দেখাচ্ছিলেন। এই পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে, আবার সব মানুষ তার আমলনামসহ একদিন পুনরুত্থিত হবে এবং সেখানে বিচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নেককারদের জান্নাত ও বদকারদেরকে জাহান্নামে দেয়া হবে-এ সব কথাবার্তা তাদের কাছে বড় অবিশ্বাস্য ও অবাস্তব মনে হচ্ছিল। তারই প্রেক্ষিতে আল্লাহ তায়ালার জিজ্ঞাসা। সেই যুগে মানুষের চলাফেরার জন্য কোন যান্ত্রিক যানবাহন ছিল না, উটই ছিল তাদের সম্বল। কত বিস্ময়কর প্রাণি, একটানা সাত দিন পানি পান ছাড়াই মরুপথে মাইলের পর মাইল চলতে পারতো এবং সে উপযোগী করেই তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। বিস্তৃত পৃথিবী যেখানে নানাবিধ শস্য ও ফলফলাদি উৎপন্ন হচ্ছে যা মানুষের প্রয়োজন পূরণ করছে। সুউচ্চ আকাশ যা চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-নক্ষত্র দিয়ে সুশোভিত করা হয়েছে, রাত ও দিনের আবর্তন, সূর্যের আলো প্রদান যার কারণে প্রাণি ও উদ্ভিদের অস্তিত্ব সম্ভব হয়েছে তা বাস্তবে দেখছে বলেই মানুষ বিশ্বাস করে। এ সবই মহা কুশলী আল্লাহপাকেরই সৃষ্টি। নিরেট নাস্তিকের সংখ্যা অতীতে যেমন খুব কম ছিল বর্তমানেও কমই রয়েছে। আল্লাহরই কথা-ওদের জিজ্ঞেস করো, কে এ সব সৃষ্টি করেছেন? ওরা বলবে আল্লাহ। আল্লাহকে স্রষ্টা মানতে আপত্তি নেই। কিন্তু আল্লাহর বিধান না মানলে যে শাস্তি ভোগ করতে হবে, তা মানতে তাদের আপত্তি। মূলত আখিরাতকে অবিশ্বাসই মানবজাতির বড় সমস্যা। আল্লাহরও জিজ্ঞাসা-প্রথমবার সৃষ্টি করা যদি কঠিন না হয়ে থাকে, তাহলে দ্বিতীয়বার সৃষ্টি কেন কঠিন হবে? আল্লাহপাক তাঁর সৃষ্টি দিয়েই বোঝাতে চেয়েছেন এ সব তিনি যেমন সৃষ্টি করেছেন, ঠিক তেমনিভাবে এ সৃষ্টি ধ্বংস করে দিয়ে আবার আর একটি জগৎ সৃষ্টি করে সেখানে সকল মানুষকে একত্র করে বিচার অনুষ্ঠান এবং পাপ-পুণ্যের পুরস্কার ও শাস্তিদানও তাঁর পক্ষে সম্ভব।

এরপর নবী (সা)-এর দায়িত্ব উল্লেখ করা হয়েছে। নবীর কাজ হলো মানুষকে সুসংবাদ দান ও ভীতি প্রদর্শন করা। সত্যটা সবার কাছে স্পষ্টভাবে পেশ করাই তাঁর দায়িত্ব। সকল যুগে সব নবীরই একই মিশন এবং তাঁরা সবাই ছিলেন জাতির একান্ত কল্যাণকামী। কিন্তু কোন নবীর সাথেই সমসাময়িক কালের লোকজন ভালো আচরণ করেনি এবং তাঁদের উত্তরাধিকারদের (দ্বায়ী ইলাল্লাহ) সাথেও চরম হীন আচরণ করেছে ও করছে। নবী-রসূলগণ কল্যাণকামী হওয়ায় দাওয়াত গ্রহণের ক্ষেত্রে খুব পেরেশান থাকতেন। আল্লাহপাক তাঁদের প্রতি ইহসান করেছেন এই বলে যে, তুমি তো কেবল উপদেশদাতা। দাওয়াত দানের ক্ষেত্রে কোন জোর-জবরদস্তি করা বা নিজেকে একেবারে পেরেশান করে তোলার কোন প্রয়োজন নেই। নবীর উত্তরাধিকার যারা দ্বায়ী ইলাল্লাহ হিসেবে কাজ করে তাদের জন্যও একই কথা প্রযোজ্য। তারা অত্যন্ত নিষ্ঠা, আন্তরিকতা, দরদ ও হেকমতের সাথে ইসলামের সুমহান আদর্শ সমগ্র মানবজাতির কাছে উপস্থাপন করবে এবং গ্রহণের বিষয়টি একান্তভাবে তাদের। পৌঁছে দেয়াটাই দায়িত্ব এবং তাতেই আল্লাহর কাছে জবাবদিহি থেকে মুক্ত হয়ে যাবে।

কিয়ামত পর্যন্ত নবী ও নবীর উত্তরাধীকারদের দাওয়াত প্রত্যাখ্যানকারী সকল জনগোষ্ঠীর পরিণতি একই হবে। আল্লাহপাক তাদের গুরুতর আযাব দেবেন। স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন যে মৃত্যুই শেষ নয়, বরং এর মধ্য দিয়ে আল্লাহরই কাছে ফিরে যেতে হবে। যেহেতু আল্লাহপাক মানুষকে বিবেক-বুদ্ধি দিয়েছেন এবং পথপ্রদর্শনের জন্য নবী-রসূল ও কিতাব দিয়েছেন, সেহেতু মানুষের ভালো-মন্দ কার্যের হিসাব গ্রহণ তাঁরই দায়িত্ব। সেখানে কারো প্রতি বিন্দুমাত্র যুলুম করা হবে না। এ দুনিয়ার জীবনে মানুষের দু’ধরনের আচরণ লক্ষ্য করা যায়। একদিকে আল্লাহর অনুগত বান্দাহ হয়ে তাঁর নির্দেশাবলী মেনে সমাজে সকলের জন্য কল্যাণকর জীবন এবং বিপরিত দিকে আল্লাহর বিধান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে সমাজে আল্লাহর বান্দাদের সাথে যুলুম-নির্যাতনের মধ্য দিয়ে এক ভীতি ও অশান্তির জীবন, এ দু’-এর পরিণতির পার্থক্য হওয়াটা ইনসাফেরই দাবী। তাই বান্দাদের হিসাব গ্রহণ আল্লাহপাক তাঁর নিজের দায়িত্ব বলে উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে একটি ভীতি কাজ করছে। অবশ্য যারা আখিরাতকে বিশ্বাস করে তাদের জীবনটা পরিচালনা করবে তাদের কোন ভয়ের কারণ নেই।

শিক্ষা :সূরাটি পুরোটাই আখিরাতকেন্দ্রিক। এই সূরাটি রসূল (সা)-এর কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাই তিনি এটি বেশি বেশি পাঠ করতেন যাতে তাঁর অনুসারীরা আখিরাত সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা ও সেভাবে জীবন গঠন করতে পারে। হযরত ইমাম মালিক (রঃ)-এর মুয়াত্তা গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে যে, রসূল (সা) সাধারণত জুমুআর নামাযে প্রথম রাকাতে সূরা জুমুআ এবং দ্বিতীয় রাকাতে সূরা গাশিয়াহ্ পাঠ করতেন। আখিরাতের একটি পরিপূর্ণ চিত্র এই সূরায় পাওয়া যায়। সেখানে আল্লাহর নাফরমানদের করুণ পরিণতি এবং নেক বান্দাদের স্বাচ্ছন্দপূর্ণ আরাম-আয়েশের জীবন উল্লেখের সাথে এর যৌক্তিকতা ও সম্ভাব্যতা তুলে ধরা হয়েছে। আখিরাতের জীবনের অসম্ভবতার কিছু নেই। বর্তমান সৃষ্টি যেমন বাস্তব এবং আল্লাহই তাঁর স্রষ্টা, তেমনি মানুষের হিসাব গ্রহণের জন্য আর একটি জগৎ সৃষ্টিও হবে বাস্তবসম্মত। কিন্তু মানুষ বড় গাফিলতির মধ্যে রয়েছে। তাই আখিরাতে বিশ্বাসী মানুষের উচিৎ গাফেলদের ঘুম ভাঙানোর জন্য বেশি বেশি করে দাওয়াত দান এবং আখিরাতে নাজাতের জন্য এটা হবে বড় ধরনের অসিলা। আল্লাহপাক আমাদেরকে আখিরাতে দৃঢ় বিশ্বাসের মাধ্যমে সব ধরনের নাফরমানি থেকে দূরে থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।






























Comments