মু’আওবিযাতাইন (আল্লাহর
কাছে আশ্রয় চাওয়ার দু’টি সূরা)
সূরা ফালাক
‘‘বলো, আমি আশ্রয়
চাচ্ছি প্রভাতের রবের, এমন প্রত্যেকটি জিনিসের অনিষ্টকারিতা থেকে যা তিনি সৃষ্টি করেছেন
এবং রাতের অন্ধকারের অনিষ্টকারিতা থেকে, যখন তা ছেয়ে যায়। আর গিরায় ফুৎকারদানকারীদের
(বা দানকারিনীদের) অনিষ্টকারিতা থেকে এবং হিংসুকের অনিষ্টকারিতা থেকে যখন সে হিংসা
করে।’’
সূরা নাস
‘‘বলো, আমি আশ্রয়
চাচ্ছি মানুষের রব, মানুষের বাদশা, মানুষের প্রকৃত মাবুদের কাছে, এমন প্ররোচনা দানকারীর
অনিষ্ট থেকে যে বারবার ফিরে আসে, যে মানুষের মনে প্ররোচনা দান করে, সে জিনের মধ্য থেকে
হোক বা মানুষের মধ্য থেকে।’’
এই
দু’টি সূরা রসূল
(সা.)-এর মক্কী জীবনের কঠিন সময়ে অবতীর্ণ হয়েছে। জাতির সবচেয়ে প্রিয় ও বিশ্বস্ত ব্যক্তি
মুহাম্মদ (সা.) কর্তৃক তাঁর জাতির কাছে ইসলামের দাওয়াত দানের সাথে সাথে আপনজনসহ জাতির
লোকেরা তাঁর সাথে শত্রুতা শুরু করে দেয়।
প্রথমের
দিকে উপেক্ষা, তারপর তাঁর বিরুদ্ধে নানাবিধ মিথ্যা প্রচারণা এবং অবশেষে তাঁর ও তাঁর
সাথীদের ওপর সীমাহীন জুলুম-নির্যাতন চালাতে থাকে। এমতাবস্থায় আল্লাহতায়ালা তাঁর প্রিয়তম
নবী (সা.)-কে সবকিছু উপেক্ষা করে আল্লাহর আশ্রয়ে নিরুদ্বিগ্ন জীবন-যাপনের জন্য বলেছেন।
বলো,
আমি আশ্রয় চাচ্ছি এ কথার মধ্য দিয়ে আল্লাহতায়ালা তাঁর রসূল ও ঈমানদারদের অন্তরে সাহস-হিম্মত
সৃষ্টি করার সাথে সাথে যারা নবী ও তাঁর অনুসারীদেরকে বাধা প্রদান করছে তাদেরকে এ কথা
বুঝিয়ে দেয়া যে তাঁর রসুল ও ঈমানদাররা সহায়-সম্বলে দুর্বল হলেও মহা শক্তিশালী এক সত্তার
আশ্রয়ে তাঁরা রয়েছেন।
আশ্রয়
চাওয়ার প্রশ্ন তখনই দেখা দেয় যখন কেউ নিজেকে বিপদগ্রস্ত মনে করে এবং নিজেকে রক্ষা করার
মত শক্তি-সাহসের অভাব বোধ করে। আবার সাহায্য তাঁরই কাছে চায় যাঁকে শক্তিমান ও তাকে
রক্ষা করতে পারবে বলে অন্তরে বিশ্বাস পোষণ করে। বাতিলের কর্তৃত্বাধীনে সাধারণত ঈমানদাররা
নানাবিধ জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়ে বড় অসহায় হয়ে পড়েন।
এটা
রসূল (সা.)-এর জীবনে যেমন ঘটেছিল তেমনি সকল যুগেই ঘটে আসছে এবং ভবিষ্যতেও ঘটতে থাকবে।
এমতাবস্থায় রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায় হলো আল্লাহর উপর পূর্ণ নির্ভরতা। আর নির্ভর করার
মত একমাত্র সত্তাই হলেন আল্লাহ তায়ালা।
এই
সমাজে লক্ষ্য করা যায় যে কেউ কোন শক্তিমানের আশ্রয়ে থাকলে (যেমন বলে থাকে আমি চেয়ারম্যানের
লোক বা আমি মন্ত্রী-এমপির লোক) সে নিজেকে অনেক বড় মনে করে এবং বেপরোয়া জীবন-যাপন করে।
একজন মু’মিনও তার মহান
রবের আশ্রয়ে থেকে নিজেকে অনেক শক্তিমান অনুভব করতে পারে।
সূরা
ফালাকে শুরু করা হয়েছে প্রভাতের রবের অর্থাৎ রাতের অন্ধকার দূর করে যিনি প্রভাতের আগমন
ঘটান তাঁর কাছে আশ্রয় চাওয়ার মাধ্যমে। আল্লাহর পরিচয় পেশ করা হয়েছে মানুষের রব, মানুষের
বাদশাহ ও মানুষের প্রকৃত মাবুদ হিসেবে।
এর
মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে যে আল্লাহই সব। ক্ষমতা, কর্তৃত্ব, সার্বভৌমত্ব বলতে যা বুঝায়
তা সবই আল্লাহর, তাঁর কোন প্রতিদ্বন্দ্বি নেই, তিনি যা ইচ্ছা করেন সেটিই হয়। এ রকম
এক মহাশক্তিমান আল্লাহতে নিজেকে সঁপে দিয়ে তাঁর বান্দাহ সম্পূর্ণ নিরুদ্বিগ্ন হয়ে যেতে
পারে।
আল্লাহর
কাছে আশ্রয় চাওয়া হচ্ছে তাঁর সৃষ্ট সকল জিনিসের অনিষ্ট থেকে। তা হতে পারে রোগ-ব্যাধি,
জীব-জানোয়ারের আক্রমণ, কোন দূর্ঘটনা বা কোন জালেমের জুলুম-নির্যাতন। তিনি যা সৃষ্টি
করেছেন এ কথার মাধ্যমে সব ধরনের অনিষ্টকারিতা বুঝালেও এখানে কয়েকটি বিষয় পৃথকভাবে উল্লেখ
করা হয়েছে।
রাতের
অন্ধকারের অনিষ্টকারিতা থেকে-যত গুম-খুন, চুরি-ডাকাতি, জুলুম-নির্যাতন সবই ঘটে রাতের
আঁধারে। যাদুটোনা এ যুগে তেমন না থাকলেও সে সময়ে প্রবলভাবে যাদুর ব্যবহার ছিল এবং রসূল
(সা.)-কে যাদু করা হলে তাঁর শরীর ও মনের উপর তা বেশ ক্রিয়া করেছিল।
মূলত
সে অবস্থা থেকে পরিত্রাণের লক্ষ্যে এ সূরা দু’টি পাঠ করার জন্য
আল্লাহর পক্ষ থেকে বলা হয়। হিংসুকের অনিষ্ট থেকে। কারণ হিংসার কারণেই মানুষ তার প্রতিদ্বন্দ্বিকে
নির্মূল করতে চায়। এ দুনিয়ায় যত ফেতনা-ফাসাদ তার মূলে রয়েছে হিংসা। এ রকম সব ধরনের
অনিষ্ট থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আল্লাহতায়ালা তাঁর বান্দাদেরকে তাঁর কাছেই সাহায্য চাওয়ার
জন্য বলেছেন।
জিন
ও মানুষ উভয় থেকেই মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। এরা উভয়ই মানুষকে অন্যায় কাজে প্ররোচনা
দিয়ে থাকে। বারবার ঘুরেফিরে আসে। আল্লাহর সাহায্য ছাড়া তাদের অনিষ্ট থেকে বেঁচে থাকা
সম্ভব নয়। জিন ও মানুষ শয়তানের এই অশুভ প্ররোচনা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য অন্তরে সর্বদা
আল্লাহকে স্মরণে রেখে তাঁর কাছেই সাহায্য চাইতে হবে।
প্রশ্ন
হচ্ছে সাহায্য কি শুধু আল্লাহরই কাছে চাইতে হবে? অন্য কারো কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করলে
বা কোন কিছু চাইলে কি গুনাহ হবে? সূরা ফাতিহায় আমরা প্রতিনিয়ত বলে থাকি-‘আমরা তোমারই গোলামী
করি এবং তোমারই কাছে সাহায্য চাই’।
আমরা
ঝড়-বৃষ্টি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ঘরে আশ্রয় নিই বা রৌদ্র থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য গাছের
ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করি বা কোন জালেমের জুলুম থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কোন শক্তিমানের
কাছে আশ্রয় চাই। যেমন মক্কার কাফির-মুশরিকদের জুলুম-নির্যাতন থেকে বাঁচার জন্য রসূল
(সা.) ও তাঁর সাথীরা বাদশাহ নাজ্জাশীর রাষ্ট্রে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এ জাতীয় আশ্রয় প্রার্থনা
সবই বৈধ।
মানুষ
আল্লাহরই প্রতিনিধি। মানুষ যাতে যথার্থভাবে আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব করতে পারে সে জন্য
আল্লাহর গুণ-ক্ষমতার অতি ক্ষুদ্র অংশ মানুষকে দান করা হয়েছে। এজন্যই বলা হয়েছে তোমরা
আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হও; আল্লাহর রঙে রঞ্জিত হও। বিপদগ্রস্ত মানুষ সাহায্য চাইলে
তাকে সাহায্য করা আল্লাহরই দায়িত্ব এবং তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে মানুষ তা করে থাকে।
মানুষ
আল্লাহর দেয়া সকল ক্ষমতা-যোগ্যতা পরিপূর্ণ ব্যবহার করে বা কারো সহযোগিতা নিয়ে সে নিজেকে
রক্ষা করার জন্য সচেষ্ট হবে। কিন্তু একজন মুসলিম ও অমুসলিমের মধ্যে পার্থক্য হলো এই
যে, মুসলিম তার পারিপার্শিক সব উপায়-উপকরণ ব্যবহার করেও এ সবের প্রতি নির্ভর না করে
সে নির্ভর করে তার মহান রবের ওপর।
রসূল
(সা.)-এর সেই হাদিসটি স্মরণযোগ্য-এক ব্যক্তি উটের পিঠে চড়ে এসে উট না বেঁধে বলে তাওয়াক্কালতু
আলাল্লাহ। রসূল (সা.) বলেন যে, উটটা বেঁধে বলো তাওয়াক্কালতু আলাল্লাহ।
তাই
জালেমের জুলুম থেকে আত্মরক্ষার জন্য কোন শক্তিমানের বা প্রাকৃতিক বিপদাপদ থেকে হেফাজতের
জন্য কোন বস্তুর সাহায্য নেয়া বা রোগ-ব্যাধি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য চিকিৎসকের সাহায্য
চাওয়া আল্লাহর দেয়া নিয়মেরই অধীন। এতে কোন দোষ নেই। (তবে আল্লাহ ছাড়া অতি প্রাকৃতিক
কোন শক্তি যেমন-দেবদেবী বা মাজারকেন্দ্রিক মৃত মানুষের আত্মা বা নবী-রসূল বা কোন ফেরেশÍার
ভালো-মন্দ করার ক্ষমতা কল্পনা করা শিরক।)
কিন্তু
মনে রাখতে হবে যে চূড়ান্ত ক্ষমতা আল্লাহরই কর্তৃত্বাধীন। চিকিৎসকের সকল চেষ্টা-প্রচেষ্টা
ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি আল্লাহ না চান। আবার জালেমের জুলুমও নির্ভর করে আল্লাহর ইচ্ছার
ওপর। আল্লাহর অনুমোদন ছাড়া জালেমের কোন ক্ষমতা নেই।
সাধারণত
আল্লাহ উভয়কেই সুযোগ করে দেন। মজলুমের প্রতি দয়া হলো তাকে সবর অবলম্বনের মত মন-মানসিকতা
দান করেন এবং এর পূর্ণ প্রতিদান অবশ্যম্ভাবী আল্লাহপাক তাকে দিবেন। এ দুনিয়াটা একটা
পরীক্ষাগার। খুবই স্বল্প সময়ের এ জীবন মূলত পাথেয় সংগ্রহের লক্ষ্যে আল্লাহর দেয়া এক
সুযোগ।
এই
দু’টি সূরায় আল্লাহ
নিজেই তাঁর রসূল (সা.) ও তাঁর বান্দাহদেরকে আশ্রয় চাওয়ার জন্য বলেছেন। তাই প্রতিদানের
আশা নিয়ে আল্লাহর কাছে চাইতে হবে এবং বারবার চাইতে হবে। নামাযে সূরা দু’টি তেলাওয়াতের
মাধ্যমে বা প্রতি ওয়াক্তের ফরজ নামায শেষে আয়াতুল কুরসি, তিন তসবিহ পাঠ (ছুবহান আল্লাহ,
আলহামদু লিল্লাহ ও আল্লাহু আকবর), সূরা ইখলাস, ফালাক ও নাস পাঠের মাধ্যমে এবং রাতে
ঘুমানোর পূর্বে এ দু’টি সূরা পাঠের মধ্য দিয়ে আল্লাহর কাছে
চাইতে হবে। এ সব আমল হাদিস থেকে প্রমাণিত।
আর
আল্লাহ তো তাঁর বান্দাহদের সাথে মিথ্যা বলতে পারেন না। তাই পূর্ণ বিশ্বাস ও নির্ভরতা
নিয়ে আল্লাহর কাছে চাইলে তিনি তাঁর বান্দাহকে বিমুখ করবেন না। চাওয়াটা বান্দাহর দায়িত্ব
ও এর মাধ্যমে প্রভূর প্রতি বান্দাহর বিনয় প্রকাশ পায়। আর বান্দাহর প্রার্থনা পূরণের
দায়িত্ব আল্লাহর। কখন কিভাবে সেটা তিনিই ভালো জানেন।
তবে
এটা ঠিক বান্দাহর কোন চাওয়া তিনি অপূর্ণ রাখবেন না। এ দুনিয়ায় না দিলেও আখিরাতে বহুগুণ
বাড়িয়ে দেবেন এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। কারণ তাঁর চেয়ে প্রতিশ্রুতি রক্ষাকারী আর
কে আছে? তাই আমাদের বিনীত প্রার্থনা এই যে, সর্বাবস্থায় মহান রবের কাছে চাওয়ার মত মন-মানসিকতা
তিনি যেন আমাদেরকে দান করেন। আমিন। ১৪/০৩/২০১৬
Comments
Post a Comment