‘সময়ের শপথ, নিশ্চয়ই
মানুষ ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত, তারা ছাড়া যারা ঈমান এনেছে, নেক কাজ করেছে, একে অপরকে
ভালো কাজের তাগিদ দিয়েছে এবং পরস্পরকে ধৈর্য ধারণ করার উপদেশ দিয়েছে।’
মক্কায়
অবতীর্ণ। মাত্র তিন আয়াতবিশিষ্ট খুবই সংক্ষিপ্ত একটি সূরা। মানুষের নৈতিক চরিত্রের
উৎকর্ষতা সাধনের লক্ষ্যে মক্কায় ছোট্ট ছোট্ট সূরায় অনেক বিষয়সম্বলিত বক্তব্য পেশ করা
হয়েছে যা শ্রোতার শ্রবণের সাথে সাথে মুখস্ত হয়ে যেত। এমনি একটি সূরা এই আসর।
সাহাবায়ে
কেরামদের কাছে সূরাটি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পরস্পর দেখা সাক্ষাত হলে সূরাটি না শুনায়ে
পরস্পর বিচ্ছিন্ন হতেন না এবং এর মাধ্যমে নছিয়ত করার হকও আদায় হয়ে যেত। ইমাম শাফেঈ
(র.) বলেন-‘মানুষের হেদায়ায়েতের জন্য এই সূরাটিই যথেষ্ট’।
মক্কায়
রসূল (সা.) যে সমাজে দ্বীনের দাওয়াত পেশ করেন সে সমাজটি ছিল বড়ই অধপতিত, পাপাচারে ভরপুর।
মক্কাবাসীরা শুধু ঈমানহারাই ছিল না, ওরা ছিল কল্যাণকর সকল কাজ থেকে অনেক দূরে। হিংসা-বিদ্বেষ,
কলহ-কোন্দল, মারামারি, ঝগড়া-ঝাটি, গীবৎ, চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই, মদ-মাতলামী, নগ্নতা-বেহায়াপনা-অশ্লীলতা-ধর্ষণ,
দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার এক কথায় সব ধরনের অপরাধ কর্মে তারা লিপ্ত ছিল।
পাপাচারমুক্ত
পৃথিবী গড়ে তোলার জন্যই মূলত আল্লাহতায়ালা শেষ নবী মুহাম্মদ (সা.)-কে মক্কার এ বর্বর
সমাজে প্রেরণ করেছিলেন। সকল জুলুম-নির্যাতন ও পাপাচারের মূলে রয়েছে আল্লাহর প্রতি ভয়
ও আখিরাতে জবাবদিহিতার অনুভূতি না থাকা। রসূল (সা.) তাঁর দাওয়াতের সূচনায় এ আহবানই
জানিয়েছিলেন।
বিশ্বজাহানের
¯্রষ্টা, মালিক ও পরিচালক আল্লাহপাকের সকল কথা এমনিতেই খুব গুরুত্বপূর্ণ। তারপর শ্রোতৃমন্ডলীর
অধিক মনোযোগ আকর্ষণের লক্ষ্যে আল্লাহপাক কথা বলার সময় নিশ্চয়ই শব্দ ব্যবহার করার সাথে
সাথে তাঁর সৃষ্টির কসমও খেয়েছেন। সময়ের কসম খাওয়ার মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে যে সময় ও কাল
সাক্ষী, সূরা আসরে বর্ণিত ৪টি গুণ ব্যক্তি, ব্যক্তিসমষ্টি বা কোন জাতির মধ্যে অনুপস্থিত
থাকলে সে বা তারা বা সে জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ইতিহাস
সাক্ষ্য দেয় যে নমরুদ, ফেরাউন, সামুদ, আদ বা আবু জেহেল-আবু লাহাব যারাই পৃথিবীতে বিপর্যয়
সৃষ্টি করেছে তারা সবাই ধ্বংস হয়েছে। বর্তমান সমাজে যারা জুলুম-নির্যাতনের সয়লাব বয়ে
দিয়েছে ভবিষ্যতে তাদের পরিণতিও একই ঘটবে।
এখানে
আল্লাহতায়ালা যে ক্ষতির কথা উল্লেখ করেছেন তা শুধু দুনিয়ার ক্ষতিই নয় বরং আখিরাতে এক
ভয়ঙ্কর ও মর্মন্তুদ শাস্তি তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। চারটি গুণবিশিষ্ট ব্যক্তি বা জনগোষ্ঠী
কেবল ক্ষতি থেকে রক্ষা পেয়েছেন বলে আল্লাহ উল্লেখ করেছেন। চারটি গুণ হলো ঈমান ও নেক
আমল এবং মানুষকে ভালোর দিকে ডাকা ও এ কাজে যত বাধা-বিপত্তি-দুঃখ-কষ্ট আসে তাতে ধৈর্যধারণের
উৎসাহ প্রদান।
ঈমান
বলতে প্রধানত আল্লাহর প্রতি ঈমান এবং তৎসঙ্গে আখিরাত, রিসালাত, কিতাবসহ অন্যান্য বিষয়েও
ঈমান। আল্লাহর প্রতি ঈমান বলতে সকল গুণাবলীসহ তাঁর প্রতি ঈমান এবং তাঁকে একমাত্র ইলাহ
হিসেবে মেনে চলা। সকল নেক কাজের ভিত্তি হলো ঈমান।
ঈমান
ও আমল হলো বীজ ও বৃক্ষের মত। জমিনে বীজ বপন করা হলে তা থেকে চারা বের হয়। চারা বের
না হলে বোঝা যায় বীজ পচে গেছে বা মাটির নীচে চাপা পড়েছে। কেউ যদি আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস
করে তাহলে অবশ্বম্ভাবী তার থেকে কেবল নেক ও কল্যাণকর কাজই পাওয়া যায়।
কারো
মধ্যে ঈমানের অস্তিত্ব তার আমলের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। যেমন হাদিসের ভাষায়-‘ঐ ব্যক্তি মু’মিন নয়, মু’মিন নয়, মু’মিন নয় যার হাত
ও মুখের অনিষ্ট থেকে অন্যরা নিরাপদ নয়’। কথা ও কাজের
মাধ্যমে মানুষকে কষ্ট দেয়া মূলত একজন মানুষের মধ্যে ঈমান না থাকারই পরিচয় বহন করে।
নেক
আমলের ধারণা অত্যন্ত বিস্তৃত। মানুষের জন্য হিতকর সব কিছুই নেক আমল। কারো কথা-বার্তা,
আচার-আচরণ, লেন-দেন, ব্যবসা-বাণিজ্য, চাষাবাদ, চাকুরী-বাকুরী বা যে কোন কাজে যদি মানুষের
কোন অনিষ্ট না হয় তাহলে বোঝা যাবে তার সকল কাজই হলো নেক আমল।
প্রচলিত
নেক আমলের পেছনে যদি কোন অসৎ উদ্দেশ্য থাকে তাহলে আর তা নেক আমল থাকে না। নেক আমলের
পশ্চাতে উদ্দেশ্য হিসেবে অবশ্যই আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি থাকতে হবে। একজন নেক আমলকারী
ব্যক্তি সমাজের সকল শ্রেণির মানুষ ও সৃষ্ট জীবের জন্য হিতকারী। তার দ্বারা শুধু মানুষই
নয় সকল সৃষ্টি নিরাপদ। সে অপ্রয়োজনে গাছের একটি পাতাও ছিঁড়ে না এবং কোন পশু-পাখিকেও
কষ্ট দেয় না।
সমাজে
ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টি ও শান্তি ব্যহত হয় এমন সকল কর্মকান্ড থেকে দূরে থাকে। সুদ-ঘুষ,
চুরি-ডাকাতি, যিনা-ব্যাভিচার-অশ্লীলতা, ওজনে কম-বেশি, ভেজাল, ধোকা-প্রতারণা, খুন-খারাবি,
ঝগড়া-ঝাটি, মারামারিসহ সবধরনের অনৈতিক কাজ-কর্ম থেকে বিরত থাকে। সব সময় মানুষের কল্যাণচিন্তা
ও কল্যাণকর কাজে সে নিজেকে ব্যস্ত রাখে।
ক্ষতি
ও ধ্বংস থেকে বাঁচার জন্য ব্যক্তিগত জীবনে ঈমান ও নেক আমলে সমৃদ্ধ হওয়ার সাথে সাথে
মানুষকে ভালোর দিকে ডাকা এবং এ দায়িত্ব পালনে পরম ধৈর্য অবলম্বনের গুণও তার মধ্যে থাকতে
হবে। সমাজে ভালো কাজের প্রসার ও মন্দ কাজের সংকোচন নির্ভর করে নেক আমলকারীরা যদি দ্বায়ী
ইলাল্লাহ হিসেবে ভূমিকা পালন করেন।
শয়তানের
অনুচররা সমাজে মন্দ কাজের প্রসার ঘটানোর জন্য সর্বক্ষণ সচেষ্ট থাকে। তার মোকাবেলায়
ঈমান ও নেক আমলের পুঁজি নিয়ে সৎ লোকগুলো যদি নিষ্ক্রীয় হয়ে থাকে তাহলে সমাজে অপরাধ
প্রবণতা অবশ্যম্ভাবী বাড়বে। তাই ধ্বংস ও ক্ষতি থেকে বাঁচতে চাইলে শুধু নিজে ঈমান ও
নেক আমলে সমৃদ্ধ হলে চলবে না।
সমাজে
সুকৃতির প্রসার ও দুষ্কৃতি দূর করার জন্য অবশ্বম্ভাবী মানুষকে ভালোর দিকে ডাকতে হবে।
ভালোর দিকে ডাকা মূলত আল্লাহর দিকেই ডাকা। আল্লাহর বাণী- ‘তার চেয়ে ভালো
কথা আর কার হতে পারে যে মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকে ও নিজে নেক আমল করে এবং বলে যে ‘আমি একজন মুসলমান’।
উম্মাহর
শ্রেষ্ঠত্বের মূলে রয়েছে মানুষকে কল্যাণের দিকে আহবান-‘তোমরাই শ্রেষ্ঠতম
উম্মাত, তোমাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে মানব জাতির কল্যাণের জন্য, তোমরা ভালো কাজের আদেশ
করবে ও মন্দ কাজে নিষেধ করবে’।
ব্যক্তিগতভাবে
নিজে ঈমান ও নেক আমলে ভূষিত হলে সমাজে কোন বাধাবিপত্তি দেখা দেয়না। বিপত্তি ঘটে তখন
যখন মন্দ কাজে অভ্যস্ত লোককে মন্দ কাজ ছেড়ে ভালোর দিকে চলতে বলা হয় বা সমাজ থেকে মন্দ
দূর করার জন্য কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।
এমতাবস্থায়
বিপদাপদ দেখা দেয় বা নিজে অন্যায় থেকে সরে আসার কারণে সাময়িক লোকসান বা স্বার্থহানী
ঘটে। আর এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য যে গুণটি অপরিহার্য তা হলো ধৈর্য। দুনিয়া ও আখিরাতে
চরম ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহতায়ালা এখানে ৪টি গুণকে এক সাথে বান্দাহদের মধ্যে
দেখতে চেয়েছেন।
সাময়িক
আবেগে অনেক কিছু করা সম্ভব; কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী নিজের জীবনটাকে আল্লাহর রঙে রাঙিয়ে
তোলা ও তাতে অবিচল থাকা এবং আল্লাহর অন্যান্য বান্দাহদেরকে নিজের মত করে (একজন দ্বায়ী
ইলাল্লাহর ভূমিকা পালন) গড়ে তোলার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চালানো কঠোর ধৈর্য ছাড়া সম্ভব
নয়। আল্লাহ মুসলিম উম্মাহ সূরা আসরে বর্ণিত চারটি গুণে গুণান্বিত হওয়ার তাওফিক দান
করুন। আমিন।
২৬/০১/২০১৬
Comments
Post a Comment