সরল
অনুবাদ
‘হা-মীম। এ কিতাব
আল্লাহর পক্ষ থেকে নাজিলকৃত, যিনি পরাক্রমশালী, সবকিছু সম্পর্কে অতিশয় জ্ঞাত, গোনাহ
মাফকারী, তাওবা কবুলকারী, কঠোর শাস্তিদাতা এবং অত্যন্ত দয়ালু। তিনি ছাড়া আর কোন উপাস্য
নেই। সবাইকে তাঁর কাছেই ফিরে যেতে হবে। আল্লাহর আয়াতসমূহ নিয়ে কেবল সে সব লোকই বিতর্ক
করে যারা কুফুরী করেছে। এরপরও দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে তাদের চলাফেরা যেন তোমাদেরকে প্রতারিত
না করে’।- সূরা আল মু’মিন ১-৪
এটা
একটা মক্কী সূরা। সূরাটি নাজিল হয়েছে আবিসিনিয়ায় হিজরতের পূর্বে। রসূল (সা.)-এর দাওয়াতে
প্রচন্ড বিরোধীতা ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছিল। কুরআনের আওয়াজকে স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য
আরবের কাফির-মুশরিকরা নানাবিধ প্রচার-প্রপাগান্ডা ও ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত শুরু করে দিয়েছিল।
অত্যাচারের
মাত্রা সীমা অতিক্রম করায় মু’মিনরা দেশ ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন
যা পূর্ববর্তী সূরা আয যুমায় উল্লেখ পাওয়া যায়। সূরা আয যুমার ও আল মু’মিন পরপর নাজিল
হয়। সূরার শুরুতেই বলা হয়েছে এ কিতাব কোন সাধারণ কিতাব নয়; এ কিতাব মহাপরাক্রমশালী
আল্লাহতায়ালার নাজিলকৃত কিতাব। এখানে আল্লাহপাকের পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে।
মানব
সৃষ্টির সূচনা থেকে আল্লাহতায়ালা মানুষের হেদায়াতের জন্য অসংখ্য নবী-রসূলের মাধ্যমে
কিতাব পাঠিয়েছেন এবং সর্বশেষ কিতাব হলো আল কুরআন। আল্লাহর পক্ষ থেকে নাজিলকৃত কিতাব
নিয়ে কাফির-মুশরিকরা সকল যুগেই বিতর্ক করেছে।
কারণ
এটা মেনে নিলে তাদের মনগড়া নিয়ম-নীতি অনুসরণের আর সুযোগ থাকে না। নানা ছলে-বলে-কৌশলে
আল্লাহর কিতাব থেকে মানুষকে দূরে রাখা, এর প্রচার ও প্রসারে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি এবং
যারা এ কিতাব নিয়ে চলতে চায় বা মানুষের মধ্যে এর বাণী ছড়িয়ে দিতে চায় তাদের বিরোধীতা
চিরন্তন।
যারা
কুরআনের পথে চলতে চায় এবং সকল বিধি-ব্যবস্থার ওপর একে বিজয়ী দেখতে চায়, তাদের সাথে
কুরআনের দুশমনদের প্রচন্ড বিরোধীতা লক্ষণীয়। সাথে সাথে এটাও লক্ষণীয় যে কুরআনের বিরোধীরা
অর্থ-বিত্ত, দুনিয়াবী মান-ইজ্জত, ক্ষমতা সব দিক থেকেই এগিয়ে রয়েছে।
এমতাবস্থায়
তাদের শান-শওকত দেখে মু’মিনদের প্রতারিত না হওয়ার জন্য আল্লাহ
বলেছেন। এ দুনিয়ায় মু’মিন ও কাফির উভয়কেই আল্লাহ পরীক্ষা করছেন।
মু’মিনের পরীক্ষা
হলো জেল-জুলুম, গুম ও নানাবিধ বিপদাপদের মধ্যে কে কতটুকু ধৈর্যধারণ করে হকের ওপর টিকে
থাকতে পারে, আর কাফিরের পরীক্ষা হলো আল্লাহর দেয়া সকল সুযোগ-সুবিধাকে কতখানি আল্লাহর
নাফরমানি ও মু’মিনদের বিরোধীতায় ব্যয় করে।
যে মহান সত্তার পক্ষ থেকে
এ কিতাব নাজিল হয়েছে তিনি নিজেই তাঁর পরিচয় পেশ করেছেন। আল্লাহ এমন এক সত্তা যাঁকে
ভয় করা যায়, নিজের অভিভাবক মানা যায় এবং যাঁর ওপর নির্ভর করে প্রশান্ত হৃদয়ে দিন যাপন
করা যায়। এখানে আল্লাহর গুণাবলী সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো।
প্রথমত
: পরাক্রমশালী। আল্লাহ তায়ালা অসীম ক্ষমতার অধিকারী। আমরা যাদেরকে এ পৃথিবীতে ক্ষমতাবান
মনে করি-হোক সে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বা মন্ত্রী-মিনিস্টার বা সরকারী আমলা বা
নেতৃবৃন্দ সবারই ক্ষমতা সীমিত এবং সবাই নিজেকে নিয়ে বড় পেরেশান।
মু’মিনদের অভিভাবক
আল্লাহ এবং অতি উত্তম অভিভাবক। তাঁকে অভিভাবক মেনে একজন মু’মিন পূর্ণ নিরাপত্তা
বোধ করতে পারে। চেয়ারম্যান ও মন্ত্রী-মিনিস্টারকে অভিভাবক মেনে অনেকে নিজেদেরকে বড়
শক্তিমান মনে করে ও সমাজে তারা কাউকে পরোয়া করে না এবং মনে করে বিপদে পড়লে এ সব শক্তিমানরা
তাদেরকে রক্ষা করবে। আল্লাহকে অভিভাবক মেনে একজন মু’মিনও নিজেকে অন্য
যে কোন ব্যক্তির তুলনায় অনেক শক্তিমান ভাবতে পারে।
দ্বিতীয়ত
: সবকিছু সম্পর্কে অতিশয় জ্ঞাত। কে আল্লাহর পক্ষে, আর কে বিপক্ষে; কে ভালো কাজ করে
বা কে মন্দ কাজ করে; ঈমানদারদের ওপর কে জুলুম করছে আর কে জুলুমের শিকার হচ্ছে-কোন কিছুই
আল্লাহ থেকে গোপন নেই। এমন কি প্রত্যেকের নিয়তের খবরও তিনি রাখেন। ঈমানদারদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন
সম্পর্কেও আল্লাহ অবহিত।
তৃতীয়ত
: গোনাহ মাফকারী ও তাওবা কবুলকারী। প্রথমে গোনাহ মাফকারী উল্লেখ করায় বোঝা যায় আল্লাহ
নিজের থেকেই তাঁর বান্দাহদের অনেক গোনাহ মাফ করে থাকেন। এক ওয়াক্ত নামায থেকে আর ওয়াক্ত,
এক জুমা থেকে আর এক জুমা বা নেক কাজের বিনিময়ে আল্লাহ তাঁর বান্দাহর গোনাহ ক্ষমা করে
দেন। নানাবিধ বিপদ-মুছিবত ও জুলুম-নির্যাতনের ফলেও মু’মিনদের অপরাধ
ক্ষমা করা হয়।
এ
ছাড়া যে কোন অপরাধ সংঘঠনের পর বান্দাহ যদি তাওবা করে তাহলে সে আর পূর্বেকৃত অপরাধের
জন্য শাস্তিযোগ্য থাকে না। তাওবাকারী অর্থ বান্দাহর গোনাহ থেকে ফিরে আসা এবং বান্দাহর
সাথে বান্দাহর হলে তা মিটিয়ে ফেলা।
মনে
রাখতে হবে গোনাহ তাদেরই ক্ষমা করা হয় যারা ঈমানদার ও অনুগত। কোন বিদ্রোহী বা কাফির-মুশরিকের
গোনাহ তাওবা ছাড়া ক্ষমা নেই।
চতুর্থত
: কঠোর শাস্তিদাতা। শাস্তিদানের ক্ষেত্রেও আল্লাহর সাথে কারো তুলনা হয় না। সাধারণত
কাফির-মুশরিক ও আল্লাহর নাফরমানদের শাস্তি দেয়ার ব্যাপারে আল্লাহর কোন তাড়াহুড়ো নেই।
তিনি অবকাশ দিয়ে থাকেন যাতে তাঁর বান্দাহরা ফিরে আসতে পারে।
যারা
ঈমানদারদের প্রতি জুলুম-নির্যাতন করে তাদের প্রতি আল্লাহর চরম ক্রোধ। সেই জালেমদের
সম্পর্কেও বলা হয়েছে-‘যারা ঈমানদার নর ও নারিকে কষ্ট দেয়, অতঃপর
তাওবা করে না তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের আজাব, আছে ভস্ম হওয়ার শাস্তি’।
অতঃপর
তাওবা করে না খুবই প্রণিধানযোগ্য। দুনিয়ার জীবনে সবার প্রতি আল্লাহ নম্র আচরণ করেন।
কিন্তু আখিরাতে আল্লাহর আযাব হবে বড় ভয়াবহ।
পঞ্চমত
: অত্যন্ত দয়ালু। আল্লাহ তাঁর বান্দাহ বিশেষ করে ঈমানদারদের প্রতি অত্যন্ত দয়ার্দ্র।
তাঁর বান্দাহদের ক্ষমা করার জন্য উদ্গ্রীব। শুধু ক্ষমা চাওয়া দরকার। যে কোন অপরাধের
শাস্তির কথা বলার সাথে সাথে তিনি বলেন-‘কেউ যদি তাওবা
করে তবে আল্লাহ গফুরুর রহীম’। দয়ালু হওয়ার কারণে বান্দাহর উচিৎ তাঁর
রহমত থেকে নিরাশ না হওয়া।
আল্লাহর
এ সব গুণাবলী উল্লেখ করার পর বলা হয়েছে-‘তিনি ছাড়া আর
কোন উপাস্য নেই এবং সবাইকে তাঁরই কাছে ফিরে যেতে হবে’। একজনকে উপাস্য
(ইলাহ) হিসেবে মানার যে সমস্ত গুণ-ক্ষমতা থাকা দরকার তা পূর্ণমাত্রায় কেবল আল্লাহরই
রয়েছে। মানুষ আল্লাহ ছাড়া যাদেরকে উপাস্য মানে তাদের কারো মধ্যে উপাস্য হওয়ার মত কোন
গুণ-ক্ষমতা নেই। আর আল্লাহকে উপাস্য না মেনেই বা উপায় কী?
এই
পৃথিবীতে যার আগমন ঘটেছে তাকে তো অবশ্বম্ভাবী আল্লাহর কাছে ফিরে যেতে হবে এবং সেই আল্লাহ
যেমন দয়ালু সাথে সাথে কঠোর শাস্তিদাতাও। ‘সবাইকে তাঁর কাছেই
ফিরে যেতে হবে’-এ কথা দ্বারা কাফির-মুশরিকদেরকে যেমন সতর্ক করা হয়েছে।
সাথে
সাথে মু’মিনদেরকে শান্তনা
দেয়া হয়েছে এ বলে-যে আল্লাহকে তোমরা অভিভাবক মেনে দু:খ-কষ্ট, বিপদ-মুছিবতের সম্মুখিন
হচ্ছ, মৃত্যু তোমাদের জীবনের পরিসমাপ্তি নয় বরং তোমাদের মহান রব, মালিক ও পরমপ্রিয়
মাওলার (অভিভাবক) কাছেই ফিরে যাওয়া এবং সেখানে তুমি মর্যাদাবান অতিথি হিসেবেই বিবেচিত
হবে।
আল্লাহ
রব্বুল আ’লামীন কুরআন মজিদে
বিভিন্ন জায়গায় তাঁর নিজের গুণ-ক্ষমতা চমৎকারভাবে পেশ করেছেন। মু’মিন বারবার এ
সব পড়ে আর তার অন্তরে মহান আল্লাহকে অনুভব করে এবং নিজের মধ্যে শক্তি ও প্রশান্তি খুঁজে
পায়। আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর পূর্ণ অভিভাবকত্বে গ্রহণ করে তাঁর ওপর পূর্ণ নির্ভরতার তাওফিক
দান করুন। ১০/০৯/২০১৫
Comments
Post a Comment